অর্ণব সান্যাল
নতুন করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এলেন যখন, সঙ্গে করে নিয়ে এলেন করোনার টিকা। তাঁর দাবি, এটিই করোনার প্রথম টিকা। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও তোলপাড় চলছে। কিন্তু পুতিনের এই দাবিতে কি ভরসা রাখা চলে?
ভ্লাদিমির পুতিন পুরোপুরি ক্যারিশমানির্ভর রাজনৈতিক নেতা। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন। সম্প্রতি সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথও সুগম করেছেন। তবে আজীবন ক্ষমতায় থাকার তথাকথিত ‘ম্যান্ডেট’ গণভোটে আদায় করে নিলেও, সেটির উদযাপন হয়নি। বরং নতুন করোনাভাইরাসের প্রকোপে পুরো রাশিয়া বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও প্রাণহানির দিক থেকে ৪ নম্বরে আছে দেশটি। যদিও পুতিন প্রশাসন লাগাতার বলেই যাচ্ছে যে অবস্থার ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছেই। এবার সেই উন্নতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই হয়তো গত ১১ আগস্ট করোনার টিকা তৈরি করে ফেলার ঘোষণা দিলেন পুতিন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবি, তাঁর দেশই প্রথম করোনার টিকা তৈরি করেছে। রাশিয়া যে টিকা তৈরি করেছে, তা স্থায়ী বা টেকসই প্রতিরোধী সক্ষমতা দেখাতে সক্ষম বলেও দাবি করেন পুতিন। এই টিকা যৌথভাবে তৈরি করেছে রাশিয়ার গামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই টিকা রাশিয়ার সরকারি নিবন্ধন পেয়ে গেছে। এখন টিকাটি ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন করে গণহারে প্রয়োগের কথাও শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে।
এককথায়—পুতিন যেমনটা চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনটাই হয়েছে। চারদিকে হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, এই টিকা পুরোপুরি নিরাপদ। এরই মধ্যে নাকি প্রায় ২০টি দেশ রুশ টিকা কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। টিকার প্রায় শত কোটি ডোজ তৈরি করা হবে বলেও রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলো রাশিয়ার এই টিকা আদৌ নিরাপদ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে। অবশ্য রাশিয়াও বসে নেই। উদ্ভাবিত করোনার টিকার নিরাপত্তা নিয়ে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক উদ্বেগ নাকচ করে দিয়ে মস্কো বলছে, তাদের অনুমোদিত করোনার টিকা নিয়ে উদ্বেগ-সংশয় ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’। রুশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিখাইল মুরাশকো বলছেন, বৈশ্বিক টিকার প্রতিযোগিতায় সুবিধা পেতেই অন্যরা এমন নিন্দা-মন্দ করছে।কিন্তু রাশিয়ার করোনা টিকা ‘স্পুতনিক ফাইভ’ কতটা কার্যকর হবে? বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি পুরোপুরি কার্যকর ও মানবদেহের জন্য নিরাপদ টিকা তৈরি করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ বিষয়। টিকা তৈরিতে বছরের পর বছর চলে যায়। যদিও এবারের নতুন করোনাভাইরাস মহামারিতে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। তবে তার পরও ধারণা করা হচ্ছে, ন্যূনতম ১২ থেকে ১৮ মাসের আগে একটি পরিপূর্ণ টিকা পাওয়া কঠিন হবে। মডার্না, ফাইজার বা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি টিকা—সবগুলোর ক্ষেত্রেই এই বক্তব্য প্রযোজ্য। কারণ, টিকা তৈরির পর তার কার্যকারিতা পরীক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি। একটি টিকা তিন ধাপে পরীক্ষা করার পর ফলাফল ইতিবাচক হলেই তা নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়। মডার্না ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির টিকা এখন পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে আছে।
টিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদক্ষেপ আছে। রাশিয়ার স্পুতনিক ফাইভ টিকার ক্ষেত্রে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষার পরই এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার আগেই কীভাবে টিকাটি অনুমোদন পেল? কারণ, গত এপ্রিল মাসে রাশিয়ার সংবিধান বদলে গেছে। এর ফলে একদিকে যেমন পুতিনের ক্ষমতা সীমাহীন হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন টিকার অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার আইনি বাধ্যবাধকতাও। জুনের ১৭ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ১ আগস্টের মধ্যেই স্পুতনিক ফাইভের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা হয়েছে। গামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এ–সংক্রান্ত গবেষণাপত্রে তেমনটাই উল্লেখ আছে। আর এর পরপরই ত্বরিতগতিতে দিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় অনুমোদন।স্পুতনিক ফাইভের পরীক্ষাসংক্রান্ত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ মিলিয়ে ৭৬ জন মানুষের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। তৃতীয় ধাপে প্রয়োগ করা হবে ২ হাজার মানুষের ওপর। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সংখ্যা খুবই কম। আসুন, তুলনা হিসেবে মডার্না ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি টিকা নিয়ে আলোচনা করা যাক। মডার্নার টিকা–বিষয়ক গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, এই কোম্পানির টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় ৬৪৫ জন লোকের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখন তৃতীয় ধাপে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হবে। অন্যদিকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি টিকার ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে এটি প্রয়োগ করা হয়েছিল ১ হাজার ৭৭ জনের শরীরে। তৃতীয় ধাপে প্রায় ৩০ হাজার লোকের শরীরে এটি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ওপরের হিসাবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাজারের অন্যান্য টিকার তুলনায় রাশিয়ার টিকা তুলনামূলক অনেক কম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই নিয়ে আসা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, মডার্না, অক্সফোর্ড বা চীনের তৈরি টিকা অনেক আগেই দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা পার করে তৃতীয় ধাপে চলে গেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে টিকার অনুমোদনের ক্ষেত্রেও রাশিয়া প্রথম নয়। গত জুন মাসেই চীন তাদের তৈরি একটি টিকা দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেহে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। সুতরাং, পুতিনের দাবি করা ‘রাশিয়া একমেবাদ্বিতীয়ম’ বক্তব্যটি সত্য নয়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় পরীক্ষায় মূলত এর স্বল্পমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা হয়। এই কারণে এই দুই ধাপে কয়েক শ মানুষের শরীরে টিকা প্রয়োগ করা হয়। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা সাধারণত হাজার হাজার মানুষের ওপর চালাতে হয়। এ ক্ষেত্রে টিকার দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং রোগে আক্রান্ত-অনাক্রান্তের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়। এই ধাপের পরীক্ষার পরই কার্যত একটি টিকার পূর্ণ সক্ষমতা ও নিরাপদ কি না—তা বোঝা যায়। এই ধাপেই বোঝা যাবে যে কোনো নির্দিষ্ট টিকা কোভিড-১৯ রোগ প্রতিহত করতে পারে কি না। এ কারণেই পরীক্ষার তৃতীয় ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুতিনের দেশ তা না করেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নিরাপদ টিকা’ আনার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে।
পুতিনের দেশের তৈরি টিকা নিয়ে আরও প্রশ্ন আছে। নিন্দুকেরা বলছেন, স্পুতনিক ফাইভ টিকার পরীক্ষা ও টিকা বিষয়ে পূর্ণ বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশ করেনি রাশিয়া। ফলে এই টিকা আদৌ কতটুকু নিরাপদ ও কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। এ ছাড়া টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়নি। রাশিয়ার টিকার প্রতি এমন অবিশ্বাসের মূল কারণ পুতিন নিজেই। তিনি যেভাবে পুরো দেশে একার শাসন জারি করেছেন এবং যে রাষ্ট্রে সবাইকেই টিকে থাকতে হলে ‘সহমত’ প্রকাশ করতে হয়, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা কঠিন। আবার স্পুতনিক ফাইভ নিয়ে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, সেটিও শুধু ঘাটতিই প্রকাশ করছে।
পুতিন তবে কেন এমন ঘোষণা দিলেন? এটি ঠিক যে করোনাকালে অন্য বিশ্বনেতাদের তুলনায় ভ্লাদিমির পুতিন পাদপ্রদীপের আলোয় ততটা ছিলেন না। রাশিয়ার জনগণের সামনেও সশরীর দেখা যায়নি তাঁকে। এই করোনার মধ্যেই গণভোট নিয়ে নিজের ক্ষমতায় থাকার সীমা বাড়ানোর ব্যাপারটিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানোর জন্য পুতিনের তাই এবার মিসাইল নয়, বরং টিকারই দরকার ছিল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ নিয়ে রুশ বিজ্ঞানীদের ওপর ব্যাপক চাপও ছিল। আর তারই ফলাফল হলো, তড়িঘড়ি করে ধুমধাড়াক্কা টিকা আনা।অন্যদিকে দেশের ভেতরেও ‘জাতীয় মর্যাদা’ পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন ছিল পুতিনের। তিনি এমন একজন নেতা, যিনি মানুষের কাছে ব্যক্তি হিসেবে ‘জনপ্রিয়’ হতে উন্মুখ। এভাবেই নিজের ক্ষমতার ব্যাটন ধরে রেখেছেন পুতিন। জাতীয় ও ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা তাই দরকার হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে বোঝানো গেল যে বৈশ্বিক বিজ্ঞানের দৌড়েও আছে রাশিয়া। ঠিক যেমনটা কিছুদিন আগে নিত্যনতুন মিসাইল-বোমা দেখিয়ে জানাতে চেয়েছিলেন সাবেক এই কেজিবি কর্মকর্তা। আবার অন্যান্য দেশ যদি বিপুল পরিমাণে এই টিকা আমদানি করে, তবে টিকা দেওয়ার নাম করে সেসব দেশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে। সমালোচকেরা বলছেন, এসব সমীকরণ মাথায় রেখেই নিয়ে আসা হয়েছে স্পুতনিক ফাইভ।
সমস্যা হলো, পুতিনের টিকাবাজির বিনিময় মূল্য হিসেবে দাঁড়িপাল্লায় মাপতে হচ্ছে মানুষের জীবন। এটিই সবচেয়ে শঙ্কার ব্যাপার। রুশ টিকা আদৌ মানবসভ্যতার কোনো কাজে আসবে কি না, সময়ই দেবে সেই জবাব।
তথ্যসূত্র: আরটি, মস্কো টাইমস, লাইভ সায়েন্স, স্পুতনিক ভ্যাকসিন ডট কম, সিএনএন, ব্যারনস ডট কম, ফোর্বস, বিবিসি ও নিউজউইক
Discussion about this post