গোলাম কবির
উদার-উন্মুক্ত প্রকৃতি মানুষের আদি শিক্ষক। এই আদি গুরু ছেড়ে আমরা কৃত্রিম যান্ত্রিকতার পথে ধাবিত। প্রকৃতিকে আমরা পরিহাস করেছি, এখন তার প্রতিফল কড়ায়-গণ্ডায় ওয়াসিল হচ্ছে।
কভিড তথাকথিত সভ্য মানুষকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য করছে। যে মিলন মানুষে মানুষে আনন্দের ধারা সৃজন করে, আজ তা প্রবলভাবে অন্তর্হিত, মিলনটাই যেন গর্হিত। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রগতির চাকা স্তব্ধ। যা চলছে, তা দায়সারা যন্ত্রের মতো। এরই মধ্যে শিক্ষা নিয়ে নানা নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। কার্যকর পরিণতির কথা না ভেবে নতুন কিছুর উদ্ভাবক হওয়ার আমরা অভিলাষী। যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রকারান্তরে বৈষম্যের পথ দীর্ঘতর করছি। যারা সারা বিশ্ব লুণ্ঠন করে যন্ত্রের সাহায্যে জীবনের গতি ফেরাতে ব্যস্ত তারা অনলাইনের প্রবক্তা। জীবনের অনেক কিছু আমাদের জন্য সহজ করেছে অনলাইন। কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষা সে পথে কতখানি অর্জিত হবে, তা বোধ করি ভেবে দেখার অবকাশ আছে।
অনলাইনে ঘরে ঘরে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। কিছু দেশ বিদেশি শিক্ষার্থী খেদিয়ে দেওয়ার আয়োজন করেছে। আসল কারণটি উদ্ঘাটনের চেয়ে নকল নিয়ে টানাটানি। মানুষ বাঁচানোর কৌশল সর্বাগ্রে, অতঃপর শিক্ষা। মানুষ নেই তো শিক্ষা কার জন্য! প্রকৃতির ভয়াল রূপে ভীত হয়ে মানুষ হারেনি কখনো।
অনলাইন শিক্ষা উচ্চতর শ্রেণির জন্য কিছুটা প্রতিকূল সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করা। তবে সব শিক্ষার্থীর তাতে অংশ নেওয়া সহজ নয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তো প্রাথমিক-মাধ্যমিকের। তা-ও আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে অনেক পরিবার উঠতে পারেনি। তাদের ভাগ্যে কী জুটবে?
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানসকর্ষণ। উপজাত হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা কৌশল আয়ত্ত করা। এখন উপজাতের প্রতি সবার আকর্ষণ, আর গুরুত্বও সেখানে। ফলে মনুষ্যত্ব যে দিন দিন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম তার প্রতি আমাদের নজর দেওয়ার সময় নেই। যে শিক্ষা মানুষকে আনন্দময় উজ্জ্বল জীবনের সঙ্গে পরিচিত করে না, তা বোধ করি পূর্ণ শিক্ষা নয়। অথচ কভিড মানুষকে নিদারুণভাবে একলা থাকার পথে নিয়ে যাচ্ছে। মানবকল্যাণের কর্মযজ্ঞ বিচ্ছিন্ন থাকলে ব্যাহত হয়।
সূচিত সভ্যতার আগে মানুষ দীর্ঘকাল উপজাত শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত ছিল না, যেটুকু আয়ত্ত করেছিল তা অভিজ্ঞতার ফসল। তাইতো বলা হয়, অভিজ্ঞতামসংস্কারমসংস্কৃতিমবিজ্ঞান। আজকের চোখ-ধাঁধানো কৃত্রিম স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও সচ্ছলতার অভাব ছিল না। ক্ষমতার মদমত্ততা প্রদর্শন আর আমৃত্যু কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় রাখার অশুভ আয়োজন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তার নিয়ামক আজকের এই কভিড। ঘরে বসে বিদ্যা আহরণে আমাদের বেশিসংখ্যক সন্তান উপকৃত হবে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে আয়োজনের তোড়জোড় কম নয়। এতে ভাগ্যবানরা যে আচরণের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে রক্ত-মাংসের যন্ত্র হয়ে উঠবে এবং মানবাচারে আদিমতাকে হার মানাবে, তা ভেবে দেখছি না। আমরা তাত্ক্ষণিকতাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। এ যেন অন্য উপায়ে মানুষে মানুষে বৈষম্যের ব্যাধি প্রকট করে তোলা!
আমাদের শিক্ষার্থীর সুবিধার জন্য দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। এমনকি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রবর্তিত হয়েছে। লাভের লাভ কতটুকু হয়েছে, গবেষকরা তা বলতে পারবেন। অবশ্য কিছু শিক্ষাজীবীর পুনর্বাসন যে হয়নি তা নয়। তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন! কভিডমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিশু-কিশোর-তরুণদের আনন্দময় মিলন তীর্থে পরিণত করে আচরণের শিক্ষার পীঠস্থানে রূপান্তর করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টা। শিকড় বহাল রেখে নতুন ধারার শিক্ষা প্রবর্তন কতখানি সফলকাম হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
কর্মহীন, অন্নহীন মানুষের মিছিল সংক্ষিপ্ত করার জন্য অবশ্যই কভিড তাড়াতে হবে। এর জন্য যা যা করা দরকার, তা শক্তি প্রয়োগ করে হলেও করতে হবে। মানুষ বাঁচবে। মানুষ না থাকলে শিক্ষা গ্রহণ করবে কে? উন্নয়ন কার জন্য? কিছু ভাগ্যবান ছাড়া বেশির ভাগ নিয়তিনির্ভর মানুষের সন্তানরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে।
আশা রাখতে দোষ নেই, সেই ফেলে আসা তপোবন সংশ্লিষ্ট শিক্ষায় মানসকর্ষণের মৌলিক বিষয় ও উপজাত শিক্ষায় আমরা সমৃদ্ধ হব। অনেকেই মনে করেন, এর পথরেখা তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯০২ সালে ভুবনডাঙায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রবর্তন করে। পৃথিবীর অযুত-নিযুত বয়ঃক্রমের কাছে আমাদের কটা মুহূর্তের শিক্ষাবিরতি শেষে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াই। দৃঢ় সংকল্প হই। সংকট কেটে যাবে।
সুতরাং শিক্ষা নিয়ে অতি ভাবনার চেয়ে বাস্তব পথপরিক্রম বুঝি জরুরি। আগেই বলা হয়েছে, আগে মানুষ তারপর শিক্ষা।
লেখক : সাবেক শিক্ষক
রাজশাহী কলেজ
Discussion about this post