প্রফেসর ড. আবদুল খালেক
বিশ্বের কোনো দেশই এখন আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে থাকতে পারে না। সমগ্র বিশ্ব এখন একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণের কারণে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর ধারণাকে আরো স্পষ্ট করেছে। আগের দিনে এক গ্রামে কলেরা দেখা দিলে পাশের গ্রামও সতর্ক ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমে কলেরার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু বর্তমানের করোনা ভাইরাস সুদূর চিন দেশের ‘উহান’ প্রদেশে যার উত্পত্তি, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশে, প্রতিটি গ্রামের আনাচে-কানাচে এমনকি প্রতিটি ঘরের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। করোনা ভাইরাসের তীব্র আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব আজ লন্ডভন্ড। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, বিশ্ব অর্থনীতি বিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত। আর্থিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে এক চরম অনিশ্চয়তা। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে জাতি পঙ্গু হয়ে যাবে। কাজেই করোনাসৃষ্ট সংকটকালে শিক্ষার বিষয়ে আমাদের কী করণীয়, শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের মধ্যেও কোন প্রক্রিয়ায় বহমান বা গতিশীল রাখা যায়, সে বিষয়ে দেশের সরকার যেমন সতর্ক রয়েছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারাও চুপচাপ বসে নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পঠন-পাঠন চালু রাখার লক্ষ্যে নানা রকম আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতির জন্য এ ধরনের আয়োজন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
অতিসম্প্রতি আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক উপকমিটি থেকে ‘শিক্ষা বিষয়ে আমাদের করণীয়’ সম্পর্কে একটি ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছিল। কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি, বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান। আলোচনায় আরো সংযুক্ত হয়েছিলেন মাননীয় মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, সাংবাদিক শ্যামল দত্ত, বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মাসুদ কামাল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর শাহিনুর রহমান প্রমুখ। পদাধিকারবলে আলোচনা অনুষ্ঠানে আমাকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক উপকমিটির সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা।
আলোচনায় যারা অংশগ্রহণ করেন, তারা সবাই সমাজের অত্যন্ত খ্যাতিমান ব্যক্তি। করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা নিয়েই অত্যন্ত গঠনমূলক আলোচনা করেন বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ। আলোচনার মূল কথা ছিল ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের ঘরে ঘরে নতুন প্রযুক্তি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রচলনের ক্ষেত্রে জনাব মোস্তাফা জব্বারের বিশেষ অবদান রয়েছে, তা আমাদের সবারই জানা। মোস্তাফা জব্বার পরিবেশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় মোবাইল ফোনের সংখ্যা অনেক বেশি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও পাঠদান করা সম্ভব। নেটওয়ার্কের সমস্যা সম্পর্কে তার বক্তব্য, প্রত্যন্ত অঞ্চলের যারা নেটওয়ার্কের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের সংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগের বেশি হবে না। সেই সমস্যা অল্প দিনের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাবে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন এবং আন্তরিক।
বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করার ক্ষেত্রে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকেই যে অত্যন্ত আন্তরিক, দেশবাসীর তা অজানা থাকার কথা নয়। ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মূল কারণ হিসেবে অনেকেই উল্লেখ করে থাকেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার নির্বাচনি ইশতেহারে দেশবাসীকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য বিষয়টি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রবীণেরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাদের কাছে মনে হয়েছিল বাংলাদেশের জন্য এটি অনেকটা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। এত দিনে এসে স্পষ্ট হয়েছে, ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতিকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন আজ প্রায় শতভাগ পূরণ হয়ে গেছে। ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের সঙ্গে সমান তালে চলার ক্ষমতা রাখে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে আমাদের দেশের পঠন-পাঠন কেমন চলছে, সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বাংলাদেশে শুরু হয় চলতি বছরের মার্চ (২০২০) মাসের দিকে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে মার্চ মাসের শেষের দিকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব ওঠে, তারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে চায়। প্রস্তাবটি প্রথম পর্যায়ে অগ্রহণযোগ্য হয় ইউজিসি কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে আশার কথা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রস্তাবটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইউজিসি কর্তৃক গৃহীত হয় এবং শেষ পর্যন্ত ইউজিসি কর্তৃপক্ষ তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। সময় নষ্ট না করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়মিত ক্লাস চলতে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদর্শিত পথে অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে পঠন-পাঠন শুরু হয়ে যায়। উত্তরাঞ্চলের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাকে পঠন-পাঠনের খবর রাখতে হয়। জানা গেছে, অনলাইনে ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। একটু বিলম্বে হলেও গত জুলাই (২০২০) মাস থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ডিজিটাল পদ্ধতি অনলাইনে পঠন-পাঠন শুরু হয়েছে। আমার নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক অ্যান্ড মেকাট্রোনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। রাজশাহীতে সে আমার বাসায় অবস্থান করছে। তাকে নিয়মিত ক্লাস করতে দেখছি। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম অনলাইনে তাদের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা বলতেই পারি, বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন অত্যন্ত উত্সাহব্যঞ্জক।
তবে এ কথা ঠিক, ‘ডিজিটাল পদ্ধতি’তে শিক্ষার্থীদের পাঠদান অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অবস্থা। ঘোল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়—এ কথা আমরা সবাই জানি। দুধ যখন মিলছে না, তখন ঘোল দিয়েই জীবন রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। এর কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নেওয়া কোনো ক্রমেই সমীচীন হবে না। কিন্তু তাই বলে এ ব্যাপারে আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। একটি পথ খুঁজে বের করতেই হবে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না নিতে পারলে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে মারাত্মক জট ও জটিলতা সৃষ্টি হবে। সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থায় স্থবিরতা দেখা দেবে। কাজেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কিছু পরামর্শ আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। আমরা জানি, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্যা সমাধানের একটি পথ নিশ্চয়ই শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় খুঁজে বের করবেন। তবে এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ—
আমার জানামতে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হয়েই আছে। এখন শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে নিয়ে এসে বসানোর সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে অত্যন্ত সীমিত আকারে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। করোনার তাণ্ডবের কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতেই হবে। এক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিকের সব বিষয়ের পরীক্ষা না নিয়ে বাছাই করা তিন-চারটি বিষয়ের প্রশ্ন দিয়ে তিন-চার দিনের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করে দেওয়া যেতে পারে। এতে কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি কোনো রকম বৈষম্য হবে না।
প্রস্তাবিত তিন-চার দিন পরীক্ষা নেওয়ার সময় জেলা পর্যায়ে নির্ধারিত পরীক্ষাকেন্দ্র ছাড়া দেশের সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তাতে সামাজিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সহজ হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যগণ এ ব্যাপারে আন্তরিক সহযোগিতা দেবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
উপজেলা পর্যায়ের প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজই দেওয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভবনের সামনে খোলা মাঠ আছে। পরীক্ষার সময় দেওয়ালবেষ্টিত খোলা মাঠটাকেও ব্যবহার করা সম্ভব। সামনের অক্টোবর মাসে বৃষ্টি-বাদল থাকবে না, তখন অতি সহজেই স্কুল-কলেজের বহিরাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব। প্রতি উপজেলাতেই একাধিক পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, এমন নয় যে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য দূরে কোথাও যেতে হচ্ছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পরীক্ষার সময় কমানো। পরীক্ষার সময় যত কমানো যাবে, ঝুঁকি তত কমে যাবে। তবে বিগত কোরবানির ঈদ উত্সব জাতি যে ঝুঁকি নিয়ে পালন করেছে, তিন-চার দিনের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করে দিতে পারলে সে তুলনায় ঝুঁকি অনেক কম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মোট কথা, এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কার্যক্রম শেষ করতে না পারলে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post