এ কে এম শাহনাওয়াজ
দুটি বিষয় আমাদের খুব চিন্তিত করে। একটি হচ্ছে, সময়ের পরিবর্তনে অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ানো হয়- হচ্ছে দু-তিন দশক ধরে। বিশেষায়িত বিদ্যায় দক্ষ-মেধাবী প্রজন্ম পাঠ শেষ করে বেরোচ্ছে।
বিষয়সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে দেশে। কিন্তু দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেসব বিভাগ না থাকায় নানা বিভাগের ডিগ্রিধারীদের দিয়ে পদ পূরণ করা হতো।
সেভাবেই নীতি তৈরি হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট দক্ষ জনশক্তি তৈরি হওয়ায় নীতিমালায় যে পরিবর্তন আনা দরকার তা বিধায়করা ভাবছেন না। ফলে নানাভাবে অপচয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে আবেদনের ও অবসরের বয়সসীমা।
আমরা অনুধাবন করতে চাইছি না, স্বাধীনতার পরে মানুষের যে গড় আয়ু ছিল তা অনেক বেড়েছে। এ কারণে এখন সময়ের বাস্তবতায় চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনের সুযোগ যেমন বাড়ানো দরকার, তেমনি বৃদ্ধি করা দরকার অবসরের সময়সীমা। না হলে সুস্থ-সবল-দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানুষগুলোর সেবা না নিয়ে বড় রকমের অপচয় করা হবে।
সারা পৃথিবীতেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বাস্তবতার নিরিখে এ বিষয়গুলোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। বাংলাদেশেও যে করা হয়নি তেমন নয়; এখন সরকারি চাকরিতে আবেদন করার সর্বশেষ বয়সসীমা ৩০ বছর আর অবসরগ্রহণ ৫৯ বছর। আমাদের মনে হয় বাস্তবতার বিচারে এ বয়সসীমা পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন।
সাধারণত দেশের কর্মসংস্থান সংকট সরকারের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি করে। দেশের বেকারত্বের চাপকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। একটি সরল হিসাব আছে। অবসরে গেলে একটি পদ খালি হবে, ফলে একজন বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে; কিন্তু আমাদের মনে হয় না এ সরল হিসাবে বেকারত্ব কমানো যায়। বেকারত্ব কমাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান করতে হয়। শূন্যপদগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হয়।
এ সত্য ভুললে চলবে না, মানুষের জীবনের পরিসীমা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৭১। জীবন পরিসীমার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ধাপে ধাপে বেড়েছে। আমি অল্প কয়েকটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৪.৯৮, এ পরিসীমা ১৯৮০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫২.৪৮। ২০০০ সালে গড় আরও বৃদ্ধি পায়। এবারে গড় আয়ু হয় ৬৫.০৫। আর ২০২০ সালের হিসাবে গড় আয়ু ৭২.৭১।
এখন চাকরিতে আবেদনের সময়সীমা ৩০ বছর পর্যন্ত। যেহেতু শিক্ষিত বেকারের তুলনায় আমাদের সরকারি চাকরির পদ সীমিত, তাই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে বেশ কয়েক বছর চাকরির জন্য প্রতিযোগিতায় থাকতে হয়। কারও জোটে, কারও জোটে না।
অবশ্য শিক্ষা সমাপনের জন্য ৪-৫ বছর হাতে পাওয়া খুব যে কম, তা নয়। তবে যেহেতু চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় পদ কম, তাই ফল বা মেধায় যারা এগিয়ে থাকে, তারা অনেকে কাম্য লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেও চাকরিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য অনেকের ক্ষেত্রে ৪-৫ বছর যথেষ্ট নয়। চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসর নেয়ার সময়সীমা নির্ধারণে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সরকারি নীতি অনুসরণ করে। ফলে বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থী ৩০ বছরের বয়সসীমা পেরোনোর কারণে ছিটকে পড়ে।
এতে দেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চরম হতাশায় নিপতিত হয়। এটি একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।
সমস্যা আরও রয়েছে। এ নিবন্ধের সূচনার কথা ধরে বলি, সব দেশের মতো আমাদের দেশে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে বিশেষায়িত বিদ্যায় স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নিয়োগের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে না। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারকরা কখনও চিন্তার পুনর্বিন্যাস করেছেন, তেমন শোনা যায় না। যেমন ভারতসহ সব সভ্য দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এবং জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্প ইতিহাসের ডিগ্রিধারীরা অগ্রাধিকার পায়। এদের অধিত বিদ্যারই প্রায়োগিক ক্ষেত্র রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে।
দীর্ঘদিন আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব পাঠের সুযোগ ছিল না। তাই প্রত্নতত্ত্ব সংক্রান্ত দফতর ও জাদুঘর পরিচালনায় অগত্যা কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞাপনে ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ভূগোল, আরবি এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়।
এদিকে ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খুলে পাঠদান শুরু হয়েছে। এসব বিভাগের শিক্ষার্থী তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে বিশেষ বিদ্যায় দক্ষ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করছে। কিন্তু তারা হোঁচট খাচ্ছে পেশাজীবনে প্রবেশ করতে গিয়ে। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা এত বছরেও নতুন করে ভাবতে পারছেন না। এখনও জাদুঘরের প্রজ্ঞাপনে পুরনো ছকটিই রয়েছে।
যাদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা তাদের কথা উল্লেখই থাকছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে আবেদনই করতে পারছে না। তাই সঙ্গত কারণেই প্রত্নতত্ত্বের স্নাতক-স্নাতকোত্তর মেধাবী শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোও।
আরেকটি ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের চিন্তার দুর্বলতা রয়েছে। আমরা অনেকেই ইতিহাস বিদ্যার বিভিন্ন ধারাগুলো ঠিক বুঝতে চাই না। বাংলার ইতিহাসের কথাই যদি ধরি, এখানে বড় দাগে প্রাচীন, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগপর্ব রয়েছে। আবার সেখানেও রয়েছে রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস, শিল্প ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের মতো উপবিভাগ। এক এক অঞ্চলের ইতিহাস গবেষক এক এক অঞ্চলের ইতিহাসের নানা শাখা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারেন।
আমার জানামতে, এখন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস বিভাগের সিলেবাসে আধুনিক যুগের ইতিহাস যতটা গুরুত্ব পায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগ ততটা নয়। এর বড় কারণ, এ যুগপর্বগুলো পাঠদানের জন্য যোগ্য গবেষক শিক্ষকের অপ্রতুলতা। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্কুল-কলেজের ইতিহাস পাঠে। অধিকাংশ শিক্ষকের সব পর্ব পড়াতে হয় বলে প্রাচীন ও মধ্যযুগপর্বের দুর্বলতা কাটছে না।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগগুলোর পক্ষ থেকে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে সিলেবাস দিয়ে দেখানো হয়েছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সিলেবাস অনুযায়ী ইতিহাস এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধিকাংশ বিষয় পড়ানোর পরও প্রাচীন ও মধ্যযুগ পর্বের ইতিহাস বিস্তারিত পড়ানো হয় এবং প্রত্নতত্ত্ব পাঠের স্বার্থে ব্যবহারিক বিদ্যার মধ্য দিয়েও চর্চা করা হয়। তাই স্কুল-কলেজের ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাসে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যাদের হাতে নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা তারা যদি বুঝতে না চান এবং প্রত্নতত্ত্বকে ইতিহাস থেকে বিযুক্ত করার পুরনো ধ্যান-ধারণায় আটকে থাকেন ,তাহলে তাদের বোঝাবে কে? ফলে পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব বিশেষায়িত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা আর মেধা অপচয়ের ক্ষতি মানতে হচ্ছে দেশকে।
এবার শুরুর কথায় ফিরে আসি। নানাভাবেই আমাদের সম্ভাবনাময় প্রজন্ম পেশাজীবনে প্রবেশের নানা পথ থেকে ছিটকে পড়ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই জীবনের পরিসীমা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পরও ৬০ বছর বয়স হলেই মানুষের চোখে সে ব্যক্তি প্রৌঢ় বা বৃদ্ধের পর্যায়ে চলে যেত। আর এখন ৭০ বছর বয়সেও মানুষ যথেষ্ট কর্মক্ষম। ৮০ বছর বয়সেও অনেকে দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারেন। কাজকর্মও করে যান।
তাই দীর্ঘ চাকরিজীবনে অভিজ্ঞ চাকুরেকে যদি ৫৯ বছরে অবসর নিতে হয়, তবে তা নিশ্চয়ই জাতীয় অপচয় হিসেবেই মনে হবে। এতে কর্মক্ষম মানুষের অনেকে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়তে পারেন।
২০২০ সালের হিসাবে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৭১। অর্থাৎ প্রায় ৭৩। এ বাস্তবতায় চাকরির আবেদনের বয়সসীমা অন্তত দু’বছর বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। আমাদের মনে হয়, আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও বেশি যৌক্তিক দাবি থাকে অবসরের সময়সীমা বৃদ্ধি করার জন্য। ১৯৭৪ সালের রিটায়ারমেন্ট অ্যাক্টে অবসরের সময়সীমা ছিল ৫৭ বছর। সেসময়ের বিচারে তা যৌক্তিক ছিল।
তখন গড় আয়ু ছিল প্রায় ৪৭ (৪৬.৯৬)। আমরা গড় আয়ুকেই যদি বিবেচনা করি, তবে ২০০৯ সালে পরিবর্তনের মাধ্যমে অবসরের সময়সীমা ৫৯ করাকে খুব যৌক্তিক মনে হয়নি। কারণ, ততদিনে গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৬৯.২২ বছর। এ পর্যায়ে অধিকাংশ চাকরিজীবী বয়স ও শারীরিক অবস্থার বিচারে যথেষ্ট কর্মক্ষম ছিলেন; কিন্তু দীর্ঘদিনে অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতার অপচয় ঘটতে থাকল। আমরা মনে করি, শারীরিক সুস্থতা থাকলে প্রত্যেকেই পুর্ণোদ্যমে আরও ৫-৭ বছর চাকরি করে যেতে পারেন।
২০০৯-এর পর আরও দশ বছর চলে গেছে। এখন আমাদের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। অথচ এখনও অবসরের সর্বশেষ বয়সসীমা আটকে আছে ৫৯ বছরে। এ অবসরে যাওয়া মানুষগুলো সুস্থতার বিচারে আরও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকছেন। পেশাজীবনে দীর্ঘদিনে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করেছেন।
এমন বিবেচনা আমরা প্রতিবেশী দেশ থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বে করতে দেখি। জনসংখ্যা অধ্যুষিত চীন ও ভারতে অবসরের সময়সীমা ৬০ বছর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণ অবসর ৬৬ বছরে। সুইজারল্যান্ড আর সুইডেনের বয়সসীমা ৬৫ বছর। তাইওয়ানে ৬৬ বছর।
কেউ কেউ যুক্তি দেন পুরনোদের অবসরে না পাঠালে নতুনদের জায়গা হবে কেমন করে। এটি কিছুটা খোঁড়া যুক্তি। সরকারি চাকরিতে অনেক শূন্যপদ পড়ে আছে। পূরণ হচ্ছে না। জনসংখ্যা আর দেশোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মপরিধি বেড়েছে। এর জন্য নতুন নতুন সেক্টর ও কর্ম সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি সেক্টরেও অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই বলে দক্ষ জনসম্পদ ব্যবহার না করাটা তো অপচয় হিসেবেই চিহ্নিত হবে। এ কারণে বিষয়টি যুক্তির সঙ্গে বিবেচনা করে আমি মনে করি সরকারি চাকরিতে অবসরের সময়সীমা অন্তত আরও দু’বছর বৃদ্ধি করা উচিত। একইসঙ্গে বিশেষায়িত বিদ্যায় যোগ্য হয়ে ওঠা প্রজন্মের সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
Discussion about this post