আহমদ রফিক
আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের এবারের বিজয় দিবস উদযাপনের আনন্দ-উচ্ছ্বাসও সেই আলোকেই প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবার তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় গোটা বিশ্ব করোনার কারণে বিপর্যস্ত। এর অভিঘাত লেগেছে নানা দিকে। আমরাও এর বাইরে নই। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাব মতে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবসগুলোর অন্যতম। বাঙালি এ দিনটিকে বাংলা-সন তারিখে চিহ্নিত করেনি। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের আরেকটি বিশেষ দিনকে কিছুটা হলেও ৮ ফাল্কগ্দুন মেনে নিয়েছিল বাঙালি। সে যাই হোক, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে মানুষের ঢল। স্মৃতির পাতায় ওই মানবঢল উজ্জ্বল। সাদামাটা একটা টেবিল ও দুটি চেয়ারে পাকিস্তানি সেনা অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ও ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের প্রতিনিধি জেনারেল অরোরা। তাদের ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। বাইরে শোকার্ত ও ক্রুদ্ধ মানুষের স্লোগান। মানুষ পাকিস্তান সেনাধ্যক্ষ নিয়াজিকে পারলে ছিঁড়ে খায় অবস্থা। বাঙালির অস্তিত্ব বিনাশ যারা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল তাদের উপাখ্যান নতুন করে লেখার আর কিছু নেই। সচেতন মানুষমাত্রেরই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্বের রক্তাক্ত অধ্যায় জানা। স্বাক্ষর-অনুষ্ঠান শেষ হতেই ছোট্ট একটি নিরাপত্তা বাহিনী নিয়াজি-ফরমানদের যেন ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় নিরাপদ আস্তানায়, সেনানিবাসে। আমাদের কর্তব্য, নতুন প্রজন্মকে এসব উপাখ্যান জানানোর জোরদার প্রয়াস চালানো।
মনে পড়ে সেই দিনের আরও কত কথা। কিন্তু পাকিস্তানবিরোধী ক্রোধ ওই উদ্যান পার হয়ে আমাদের সমাজ থেকে কিছুকাল পরই কী করে হাওয়ায় উড়ে গেল তা এক বিস্ময় এবং রাজনৈতিক পরীক্ষার বিষয়। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন লাল ফুলের সমারোহ ছিল না কিন্তু উপস্থিত অগণিত মানুষের মনে ছিল স্বজন হারানোর বেদনায় রক্তক্ষরণ। অন্যদিকে বিজয়ের ফুলফোটা আনন্দ। চোখের সামনে রক্তস্নাত লাল টুকটুকে দিন। মানুষ নতুন করে আশা-স্বপ্নে বুক ভরে নিয়েছিল, এবার শান্তি-মুক্তির সন্ধান পাওয়া গেল। আনন্দ-বেদনা এই অনুভূতি নিয়েই মানুষ পুনর্বার স্লোগান তুলেছিল ‘জয় বাংলা’। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে অনেক প্রশ্ন তাড়া করে। স্বাধীনতা পেলাম কিন্তু মুক্তি পেলাম কিনা- আজকের বাস্তবতায় এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মর্মন্তুদ অধ্যায় সৃষ্টি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। তারপর থেকেই পাকিস্তানপ্রেমীদের শুরু হলো ফের অপতৎপরতা। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী অপকাণ্ড। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সহায়তায় তাদের ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে একপর্যায়ে খুলে গেল ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বদ্ধ কপাটও। এর পরের ইতিহাসও সচেতন সবারই জানা। স্বাধীনতার শত্রুরা রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক হলো। তাদের মন্ত্রী বানানো হলো। গাড়িতে উড়ল রক্তে ভেজা পতাকা। তবে আমাদের সৌভাগ্য, ক্ষমতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি সরকার গঠন করে এবং ঘাতক-দালালদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। দণ্ডিত ঘাতক দালাল অনেকের রায়ও ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। তবে এটুকুতেই যেন আমরা আত্মতুষ্টিতে না ভুগি। এখনও ঘাতক-দালাল অনেকের বিচার চলছে। এই বিচার দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে।
ধর্মান্ধ-উগ্রবাদীরা স্বাধীন দেশে আস্ম্ফালন তো কম করেনি। জঙ্গিদের হিংস্রতা, পশ্চাৎপদ চিন্তার ধারক-বাহকদের আস্ম্ফালনের ছাপও স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে দুর্ভাগ্যজনক। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও তাদের হিংস্রতা-উগ্রতা এ প্রশ্নও দাঁড় করায়- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির হাতে দেশের শাসনভার থাকার পরও তারা এমনটি চালায় কী করে? প্রশ্নটির উত্তর প্রীতিকর নয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। দেশ-জাতির শত্রুরা, ধর্মান্ধ-উগ্রবাদীরা আজ ফের আস্ম্ফালন করছে, এর পেছনের কারণগুলোও আমাদের অজানা নয়। ভোটের রাজনীতির সমীকরণে তাদের সঙ্গে নানারকম দফারফা হলো; যা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যারা দফারফা করলেন তারা এটুকু বুঝলেন না এরা কখনোই তাদের সহায়ক শক্তি হবে না। এখন প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক-বাহকদের নবপ্রত্যয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে এদের আবার রুখে দিতে হবে। যে জাতি একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে সেই জাতি এদের আস্ম্ফালনের কাছে মাথা নত করবে? না, তা হতে পারে না। আমাদের সামনে গণজাগরণের অনেক অধ্যায় রয়েছে। স্বাধীন দেশেও এমন প্রেরণা জাগানিয়া অধ্যায় রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে আমাদের মূল প্রত্যয় হোক, অপশক্তিকে আমরা রুখে দেবই।
আবার একটু পেছনে ফিরে তাকাই। একাত্তরের এই দিনে বিজয় নিয়ে মানুষের উন্মাদনা শিখর উচ্চতায়। রাজপথে শিক্ষায়তনের ক্যাম্পাসে চেনা-অচেনা মানুষ পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে গভীর আবেগের প্রকাশ ঘটিয়ে। তাদের চোখে আনন্দ ও বেদনার জল। কাউকে দেখা গেছে গাড়ির সামনের কাচে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ কাগজ কাটা শিরোনাম সেঁটে ঘুরে বেড়াতে। সে এক বিস্ময়কর আবেগ, যা ভোলা যায় না। অনেকে দিনটা রাজপথেই কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন। এমনকি পরের দিনটাও। একটা স্মৃতি উল্লেখ করতে চাই। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান রূপসী বাংলার) সামনে চলমান নানা বয়সী মানুষের একটি মিছিল। ফর্সা মুখ, গাঢ় লাল ফ্রক পরা বছর তিনেকের একটি মেয়ে তার বাবার কাঁধে চেপে ওই মিছিলে শামিল। তার হাতে ধরা সোনালি সুতোয় বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা একটি পতাকা, যেটা পুরো নয় মাস ফ্রিজের নিচে লুকানো ছিল। সেটা হাল্ক্কা হাওয়ায় দুলছে। ভোরের কাঁচা সোনা রোদে ঝিলমিল করছে সোনালি সুতোর বুনোনি। শিশুটির গলায় আধো স্বরে উচ্চারণ- ‘জয় বাংলা’। মিছিলের মানুষ মহাখুশিতে সেদিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। জয়ের আনন্দ, জয়ের তৃপ্তি নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ‘সাকুরা’র সামনে দিয়ে গড়িয়ে চলছে একটি ট্যাঙ্ক। তার ওপর একজন শিখ সেনা। কয়েকজন তরুণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে সেদিকে ছুড়ে দিচ্ছে লাল-হলুদ গাঁদা ফুল। সৈনিকটি মহাখুশিতে দু-একটি ফুল লুফে নিয়ে মাথায় ঠেকাচ্ছে। হাত তুলে হাসিমুখে পাল্টা অভিবাদন জানাচ্ছে যদিও কথাগুলো বোঝা যায়নি।
বিজয়ের দিনটি এমনই ছিল একাত্তরে। আবেগ-উল্লাস-আনন্দের মহাস্রোত। সেই সঙ্গে হৃদয়ের রক্তক্ষরণেরও সময়। যখন খবর আসছিল বধ্যভূমি থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ সম্পর্কে, তখন হৃদয় ভারী হতে থাকে। যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তার নিকটজনদের কান্নার শব্দ সহ্য করার মতো ছিল না। তবু বড় স্বস্তির ছিল বিজয়ের এই দিনটি যখন নিশ্চিত হওয়া গেছে। তখন মানুষ নামের পাকিস্তানি বর্বরগুলো আর কারও ওপর হামলে পড়তে পারবে না। নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত নতুন দেশের মুখ, স্বাধীন ভূখণ্ড, নাম তার বাংলাদেশ। নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। প্রত্যাশা পূরণ হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালির। কিন্তু এই অর্জনের বিপরীত ধারার মানুষও সেদিন ছিল আবেগে-উচ্ছ্বাসে। আমরা মুদ্রার অপর পিঠের দিকে তাকাইনি। এ কথা ভেবে দেখিনি জামায়াত, নেজামে ইসলাম বা মুসলিম লীগের মতো পাকিস্তানপন্থি দলের সমর্থক বাঙালি তথা রাজাকারের সংখ্যা কি খুব কম ছিল? আজ তারা আরও বেড়েছে। নানা ব্যানারে, নানা নামে তারাই আস্ম্ফালন করছে।
Discussion about this post