ড. মো. ফরজ আলী
৬ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। স্বাধীন দেশ চাই, আর পাকিস্তানিদের দাসত্ব করতে চাই না। শহর, বন্দর, গ্রামে একই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশ উত্তাল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সশস্ত্র সাজে সজ্জিত হয়ে নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নারী, পুরুষ, শিশু কেউই তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নির্বিচারে সবার ওপর গুলি চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রেডিওতে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ, জ্বালা-পোড়াও, নারী নির্যাতন ও লুটতরাজের খবর সার্বক্ষণিক প্রচার হচ্ছে।
এ ঘৃণ্যতম আক্রমণের দাঁতভাঙা জবাব দিতে এবং দেশকে স্বাধীন করতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অঘোষিত বন্ধ। টগবগে ছেলেরা যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণের জন্য দলে দলে ভারতে যাচ্ছে।
আবার ট্রেনিং শেষে দেশে প্রবেশ করে বিচ্ছিন্নভাবে শত্রুর মোকাবেলা করছে। এই ট্রেনিংপ্রাপ্তদের কাছেও গোপনে গোপনে দেশের দুরন্ত ছেলেরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও মা-বোনের সম্ভ্রম হরণের চিত্র বিবেকবান মানুষকে বিচলিত করত। তাই প্রতিশোধ। এ প্রতিশোধ নেয়ার প্রত্যয় থেকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম।
যুদ্ধক্ষেত্রে আমিও যে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে পারি এমন ধারণা বা যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করার যথেষ্ট জ্ঞান তখনও হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি এবং মাঝেমধ্যেই হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ, তাদের অদৃশ্য শক্তি প্রদর্শন সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করত এবং মুক্তিযুদ্ধে যেতে বিপুল উৎসাহ জোগাত।
সবেমাত্র ৭ম শ্রেণি পেরিয়ে ৮ম শ্রেণিতে প্রবেশ করেছি। বয়স ১৩-১৪ বছর। হালকা-পাতলা গড়ন। বয়স ও শারীরিক গঠনের কারণে কেউই আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার উৎসাহ দিতেন না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। যুদ্ধে যেতেই হবে। যুদ্ধের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে অস্ত্রের ট্রেনিং নেয়া অপরিহার্য। পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ট্রেনিং প্রদানে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।
নৌকা ভাড়া করে দলে দলে ভারতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি ও দলে অন্তর্ভুক্তির জন্য গোপনে তালিকা করা হচ্ছে। কোনোক্রমেই তালিকাভুক্ত হতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি একই কথা- আমার যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি। বয়সের ঝুঁকি মনে করে কেউই আমাকে সঙ্গে নিতে চায়নি। মামা ও গ্রামের কয়েকজন কলেজছাত্র মিলে ভারতে যাওয়ার জন্য একটি দল গঠন করল।
লুকিয়ে লুকিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকলাম। কখন কোন নৌকা রওনা হয়। সময়টা ছিল জুলাই-আগস্ট, ১৯৭১। দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নৌকাপথে মানকিয়ার চর বর্ডার হয়ে ভারতে প্রবেশ করবে। ইতোমধ্যে বড় একটা নৌকা ভাড়া হয়ে গেছে। যারা নৌকার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত অর্থাৎ যারা নদ-নদীবেষ্টিত এলাকায় বসবাস করেন, নদীপথে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন, তারা বড় নৌকার গঠন সম্পর্কে অবশ্যই অবগত আছেন। নৌকার পেছনের অংশে পাটাতনের নিচে বিশাল খালি জায়গা। আমার মতো ছোট আকারের দেহ সহজেই পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখা যায়। দুপুর ১২টার দিকে নৌকা পাল তুলল।
সবার চোখে ধুলো দিয়ে নৌকার পাটাতনের নিচে অবস্থান করে আমিও রওনা হলাম মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভারতের উদ্দেশে। প্রবল বাতাসে নৌকা ঝড়ের বেগে চলছে। তখনও কেউ জানতে পারেনি আমার সচতুরতা ও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কৌশল। নদীপথে ভারতে অসংখ্য বাঙালি পাড়ি জমাচ্ছে, যা পাকিস্তানি আর্মিরা ইতোমধ্যে আঁচ করতে পেরেছে।
ফলে নদীপথ সে মুহূর্তে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বাহাদুরাবাদ ঘাট যেন মরণফাঁদ। এ স্থান অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকেরই সলিল সমাধি হয়েছে। পাকিস্তানি আর্মিরা এখান থেকে সার্চলাইটের মাধ্যমে নৌকার গতিপথ পর্যবেক্ষণ করত। সন্দেহ হলে গুলি করে নৌকা নদীতে ডুবিয়ে দিত। কখনও কখনও নৌকা ধরে তীরে আনত এবং মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যাচ্ছে সন্দেহে নৌকার আরোহীদের ব্রাশফায়ার করে মৃত্যুকূপে নিক্ষেপ করত। সুতরাং এ অংশটি অতিক্রম করতে পারলে ধরে নেয়া হতো জীবন বাঁচল, সেই সঙ্গে ভারতে প্রবেশ করাও নিশ্চিত হল।
রাত প্রায় ৩টা। হঠাৎ আল্লাহু আকবর ধ্বনি। বুঝতে পারলাম বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রান্ত হয়েছে। সবাই জীবন রক্ষা করতে পেরেছি। দীর্ঘ সময় পাটাতনের নিচে নিজেকে কুঁচকে রাখার বেদনার অবসান ঘটিয়ে বীরদর্পে আমিও পাটাতনের উপরে উঠে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিলাম। সবাই অবাক, আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল আমি কীভাবে তাদের সাথী হলাম।
কেউ কেউ আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার এহেন কৌশলকে চমৎকার বলে প্রশংসা করলেও মামা খুব মন খারাপ করলেন। কারণ যুদ্ধ করার জন্য আমার শারীরিক যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি খুবই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু আফসোস, পিছু হটার আর কোনো সুযোগ ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মানকিয়ারচর বর্ডারে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আসাম রাজ্যের মানকিয়ারচর বর্ডার।
শুধু মানুষ আর মানুষ। বাংলাদেশ থেকে দলে দলে হিন্দু শরণার্থীরা এখানে এসে জনসংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তার দু’পাশে তাঁবুর মধ্যে তাদের বসবাস। বৃষ্টিতে তাঁবুর ভেতর কাদা পানি, বসবাসের একেবারেই অযোগ্য। তার মধ্যে গাদাগাদি হয়ে শরণার্থীদের বসবাস। সে যে কী করুণ দৃশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হল মরণটিলা/ময়নটিলা ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণের যোগ্যতা নির্ধারণে এটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের স্থান। টিলার উচ্চতা এত বেশি যে, একবার সমতলে নামলে উপরে ওঠার সাহস হারিয়ে যায়। যাচাই-বাছাইয়ের সময় আবার একই বিপত্তি। আমাকে নিয়ে টানাটানি। এত অল্প বয়স এবং হালকা-পাতলা শরীর নিয়ে যুদ্ধ করার সক্ষমতা নেই মর্মে বিচারকদের ধারণা। বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো অসম্ভব বিবেচনায় দলের সবার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। হুকুম হল, ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার জন্য।
কখনও স্থলপথে বাস-ট্রাক আবার কখনও জলপথে লঞ্চ-স্টিমারে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে উপস্থিত হলাম পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণের ক্যাম্পটি ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন। ক্যাম্পে সারিবদ্ধভাবে তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে। এক তাঁবুতে ৫-৭ জনের থাকার ব্যবস্থা। তাঁবুর মধ্যে মাটিতে খেজুরের পাটি, তার ওপর কম্বলের বিছানা। কয়েকটি কোম্পানিতে বিভক্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অ্যালফ্যাবিটিক্যাল অর্ডারে কোম্পানির (আর্মিদের প্লাটুন, কোম্পানি থাকে) নামকরণ করা হয়েছে।
যেমন এ কোম্পানিকে ‘আলফা’, ‘বি’ কোম্পানিকে ‘বেটা’, ‘সি’ কোম্পানিকে ‘চার্লি’ ইত্যাদি। আমি অন্তর্ভুক্ত হলাম ‘এল’ বা ‘লিমা’ কোম্পানিতে। কোম্পানির বরাদ্দ পেয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। প্রত্যেককে দেয়া হল দুটি গেঞ্জি, দুটি হাফপ্যান্ট, দুটি গামছা অর্থাৎ জোড়া জোড়া প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এ জিনিসগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো অসম আকৃতির। গেঞ্জি পরিধান করলে কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত হতো।
হাফপ্যান্টের এক পা-পথেই আমার দু’পা চলে যেত। ভ্যাগিস, গামছা ছিল। হাফপ্যান্টের হুকের মধ্যে গামছা ঢুকিয়ে কোমর বেঁধে রাখতাম আর হাফপ্যান্টের নিচের অংশ গিয়ে পায়ের গোঁড়ালি ছুঁই ছুঁই করত। হাফপ্যান্ট পরিধান করলে পোশাকের যে সৌন্দর্য দৃশ্যমান হতো, তাকে শুধু আদিম যুগের পোশাকের সঙ্গে মেলানো যায়।
ক্যাম্পটি কাঁটাতারের মজবুত বেড়া দ্বারা বেষ্টিত জনবসতিহীন পাহাড়ি এলাকা। ভারতবিরোধী কিছু দুষ্কৃতকারীর পাহাড়ের পাদদেশে লুকিয়ে থাকার এক ধরনের আশ্রয়স্থল। এক পাশ দিয়ে পাহাড় থেকে লেক প্রবাহিত হচ্ছে। লেকের ওপারে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। হিংস্র বন্যপ্রাণী ও দুষ্কৃতকারীদের যৌথ আক্রমণে এলাকাটিতে বসবাস ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অতি সাবধানতা অবলম্বন করলেও কতিপয় ট্রেনিং প্রত্যাশী ব্যক্তির জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে প্রাণ হননকারী মানব-প্রাণীর জোট। দল ছাড়া একা চলাফেরা নিরাপদ নয় বিধায় ক্যাম্পের বাইরে একা যাওয়া নিষেধ ছিল। ক্যাম্পে খাওয়া-দাওয়ার আইটেম ছিল অদ্ভুত। মাছ না অন্য কিছু, মাংস, তা কিসের মাংস বুঝতাম না। অন্য দেশের সাহায্যে যা আসত সেটাই খেতে দিত। সেটা হালাল না হারাম জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল না। তবে নির্ভেজাল ও তাজা চা পাতার ঘ্রাণ এখনও ভোলা যায় না। সুস্বাদু চা-ই মূলত ক্ষুধা নিবৃত করত। পেছনে হাফ লিটারের একটি মগ সব সময় বাধা থাকত। ৩-৪ ঘণ্টা পরপর চা পান করতাম। তার স্বাদ একমাত্র অমৃত সুধার সঙ্গে তুলনা করা যায়। খুব স্বল্প সময় নাস্তা এবং দুপুরের খাবারের জন্য বরাদ্দ থাকত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাবার শেষ করতে না পারলে না খেয়েই ট্রেনিংয়ে উপস্থিত হতে হতো। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ট্রেনিং চলত (নাস্তা ও দুপুরের খাওয়া বাদে)। ট্রেনিং শুরু হতো পিটি দিয়ে।
একেক দিন একেক রকম পিটি হতো। এর মধ্যে বল খেলা ছিল অন্যতম। ক্যাম্প থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বিরাট মাঠ। প্রতিটি পক্ষে ১০০ জন করে খেলোয়াড়। হাত দিয়ে হোক আর পা দিয়ে, গোল দেয়া চাই। যে দল হারবে তাদের প্রত্যেককে শাস্তিস্বরূপ বিজয়ী দলের একজনকে কাঁধে করে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে হতো। মজার বিষয় ছিল, শারীরিক গঠন পাতলা ও ছোট হওয়ার কারণে জিতি বা হারি প্রতিবারই অন্যের কাঁধে উঠে ক্যাম্পে যেতাম। পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করতেন একজনের কাঁধে অন্য আরেকজন আছে কিনা।
তারপর নাস্তা খেয়ে দৌড় দিতাম প্রাকটিক্যাল ট্রেনিংয়ের জন্য। ভারতের অভিজ্ঞ ও হিংস্র প্রকৃতির শিখ ও গারো সৈনিকরা ট্রেনিং প্রশিক্ষক ছিলেন। তাদের আমরা ওস্তাদ বলে সম্বোধন করতাম। রাইফেল, এসএমজি (স্টেনগান), এলএমজি এবং অন্যান্য সমমানের অস্ত্র সম্পর্কে বাস্তব ও তাত্ত্বিক ট্রেনিং হতো। রাতের অন্ধকারে অস্ত্রের যন্ত্রাংশ খুলে আবার অস্ত্রকে সক্রিয় করার ট্রেনিং সত্যি অনেক জটিল ছিল। মাইন, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ ইত্যাদি ব্যবহারের যথাযথ জ্ঞান অর্জনে রীতিমতো ক্লাস করতে হতো।
উল্লেখ্য, সে সময় পাকিস্তানি আর্মি বিশ্বের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী বলে সুপরিচিত ছিল। স্বল্প সময়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ পাকিস্তানি আর্মিদের চ্যালেঞ্জ দেয়া এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা মোকাবেলা করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবশ্যই হিম্মতের বিষয় ছিল। প্রশিক্ষকরা বেশিরভাগ হিন্দি ভাষায় কথা বলত। স্বল্প পরিমাণ ইংরেজির ব্যবহার ছিল। প্রথমদিকে হিন্দি ভাষা বুঝতে না পারার কারণে উল্টাপাল্টা কাজ করতাম। এ জন্য মাশুলও কম দিতে হয়নি। ওস্তাদদের চড়-থাপ্পড়-লাথি লেগেই থাকত।
পরে অবশ্য হিন্দি ভাষা বুঝতে পারা এবং বলা দুটোতেই পারদর্শী হয়েছিলাম। ভাষা বুঝতে সহায়তা করার জন্য প্রতি কোম্পানিতেই অভিজ্ঞ একজন ট্রেইন্ড বাঙালি ওস্তাদ থাকতেন, যিনি হিন্দি ভাষাকে বাংলায় অনুবাদ করার দায়িত্বে থাকতেন। প্রশিক্ষণ চলাকালে হিন্দি কথোপকথনের বিপরীতে বাঙালি ওস্তাদ যেভাবে বলতেন, সেভাবেই আমরা রেসপন্ড করতাম।
তাদের ইন্টারপ্রিটার বলা হতো। মজার বিষয়, একদিন হঠাৎ এক বাঙালি ইন্টারপ্রিটারকে দেখলাম কান ধরে বারবার ওঠবস করছেন। তারপর বুকডন ও ক্রোলিং। আমরা সবাই বিস্মিত! ব্যাপার কী? পরে জানতে পারলাম প্রশিক্ষক যা বলেছেন বাঙালি ইন্টারপ্রিটার তার ভুল অনুবাদ করায় আমরা অন্যভাবে রেসপন্ড করেছি। ফলে শাস্তিটা তাকেই দেয়া হয়েছিল। অল্প বয়স হওয়ার কারণে ওস্তাদদের থেকে কোনো অনুকম্পা পেতাম না। সবার মতো ট্রেনিংয়ে পারদর্শী না দেখাতে পারলে নেমে আসত চরম শাস্তি।
মনে হতো শাস্তিটা ট্রেনিংয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সপ্তাহে একদিন ছুটি থাকলেও ওই দিন ব্যস্ত রাখা হতো লেক থেকে বালির বস্তা উপরে টানাটানির মাধ্যমে।
অবশেষে ট্রেনিং সমাপ্ত। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ হল ফ্রিডম ফাইটার নম্বর (এফএফ নং)। রওনা হলাম তরঙ্গপুর ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে, যেখান থেকে আমাদের প্রত্যেকের নামে অস্ত্রের বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। তরঙ্গপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালে কিছু অভিজ্ঞতা ও ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতির কারণে প্রয়োজনীয় খাবার, খাবার বাসন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ অপ্রতুল ছিল। খাওয়ার বাসন হিসেবে ব্যবহার হতো কলাপাতা। এর স্বল্পতায় ব্যবহার হতো কলাগাছের ডোঙা (কলাপাতা নয়)। কিছুদিনের অবস্থানে আশপাশের কলাগাছের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছিল।
বাসন হিসেবে আনা হল আখের রস জ্বাল করার কড়াই। কড়াইয়ের মধ্যে ২০-২৫ জনের ভাত ও তরকারি মিশিয়ে রাখা হতো। কড়াইয়ের চারপাশে পা রাখার জায়গা খালি থাকত। আমরা কড়াইয়ের মধ্যে উঠে খাওয়া শুরু করতাম। খাওয়া শেষ হলে নেমে আসতাম এবং একইভাবে বাকিরা অবশিষ্ট খাবার খেত। কয়েকদিনের মধ্যে তরঙ্গপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের আহাজারি উপলব্ধি করলাম। বর্ডারে যুদ্ধ চলছে।
ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করত। আর পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যাম্বুশের আওতায় কত মুক্তিযোদ্ধা যে প্রাণ হারিয়েছেন তা মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। আমাদের অবশ্য বর্ডারে যুদ্ধ করতে যেতে হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করার প্রয়োজনে দ্রুত দেশাভ্যন্তরে আসতে হয়েছে। মানকিয়ারচর হয়ে নদীপথে আবার নিজ জেলা সিরাজগঞ্জে।
থাকার জন্য প্রথম আস্তানা হল যোগাযোগবিহীন একটি চর এলাকায়। রাতযাপন করতাম কখনও গোয়ালঘরে খড় বিছিয়ে, কখনও খোদ গৃহস্থালির শোয়ার ঘরে। মুহূর্তে মুহূর্তে স্থান বদল করতাম যাতে শত্রুবাহিনী আমাদের অবস্থান জানতে না পারে। এতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করার পরও রাজাকার-আলবদরের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আমাদের নৌকা লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। লক্ষভ্রষ্টের কারণে সে যাত্রা আমরা বেঁচে যাই।
নভেম্বর মাস, পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানা সদরে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করি। আমরা থানার পশ্চিম দিক থেকে গ্রুপ কমান্ডার মো. আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সব গ্রুপের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিল মো. লুৎফর রহমান।
জনাব সাত্তার অত্যন্ত সাহসী বটে, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কখনও কখনও অতি সাহসিকতার পরিচয় বহন করত। আমরা খোলা মাঠে অবস্থান নিয়ে ক্রলিং করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি। সংরক্ষিত বাংকার থেকে পাকবাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে সহযোদ্ধা চাঁন মিয়া নিহত এবং মো. আমজাদ হোসেন ও আবুল কাসেম গুলিবিদ্ধ হয়। দিনব্যাপী যুদ্ধ চলমান থাকায় প্রয়োজনীয় গোলাবারুদের স্বল্পতা দেখা যায়। ফলে শেষ চেষ্টা করেও থানা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
সুরক্ষিত বাঙ্কারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানের কারণে যুদ্ধে ততটা সফলতা না এলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘিরে ফেলেছে। তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে বিশেষ পাহারায় পর্যায়ক্রমে জেলা সদরে পালিয়ে যায়।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিরাজগঞ্জ শহরের অদূরে শৈলমারী-ভাটপিয়ার নামক স্থানে আরও একটি ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। সেখানেও সকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে প্রাণ যায় সোহরাবসহ কয়েকজন সহযোদ্ধার। উল্লেখ্য, জনাব আমির হোসেন ভুলু সে সময় সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর কোনো সংঘাত ব্যতিরেকে সিরাজগঞ্জ শহর শত্রুমুক্ত হয়।
দীর্ঘ সংগ্রাম ও নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আসে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সবার বাঁধভাঙা আনন্দ। তবে এ আনন্দ অর্জিত হয় লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর এর সঙ্গেই সমাপ্ত ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধের। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বিজয়-পরবর্তী কিছুদিন কাটল জেলা সদরের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে।
অতঃপর বাংলাদেশ ও ভারতের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত যৌথবাহিনীর কাছে সিরাজগঞ্জ ম্যালেশিয়া ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশে। বিদায়লগ্নে সহযোদ্ধা এসএম তরিকুল ইসলাম, আবদুর রশীদ, আমজাদ হোসেন, সুজাবত আলী, আমিরুল, হাবিবুর, ওহাব, তোফাজ্জেলসহ অনেকের চোখ ছল ছল করছিল।
একই গ্রামের অধিবাসী ও সহযোদ্ধা আবদুস সামাদ, আবুল কাসেম, আজিজুর ও মামা সামসুল হক একযোগে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। শুধু বাড়ির লোকই নয়, গ্রামের অনেক লোকই আমাকে দেখতে এলো, আদর করল আর প্রশংসা করল আমার কিশোর বয়সের সাহসিকতা ও বীরত্বের। জীবনের শেষলগ্নে উপনীত হয়ে স্মরণ করছি সেই সহযোদ্ধাদের। তাদের মধ্যে জানা-অজানা অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।
স্বাধীনতা এসেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বাঙালির গৌরব ও বিরত্বের ইতিহাস, এ ইতিহাস ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, এ ইতিহাস লাখ লাখ মা-বোনদের সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস, এ ইতিহাস পৃথিবীর বুকে বাঙালির মাথা উঁচু করে কথা বলার অধিকার আদায়ের ইতিহাস, এ ইতিহাস বাঙালির বাক-স্বাধীনতা প্রকাশের ইতিহাস এবং এ ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ইতিহাস, যা ইতোমধ্যেই তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবে রূপ দিতে চলেছেন। জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের, জয় হোক বাঙালি জাতির, জয় হোক বাংলাদেশের।
ড. মো. ফরজ আলী : পরিচালক, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড
Discussion about this post