ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
বাংলা নববর্ষ যেমন একান্ত বাঙালির, তেমনি খ্রিস্টীয় নববর্ষও খুব দূরের নয়। এই নববর্ষের আগমনী সুরে একটি বৈশ্বিক পটভূমি যেন তৈরি হয়ে যায়। বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা এখন ক্যালেন্ডারের বিচারে জীবনচর্চায় খ্রিস্টীয় নববর্ষকেই ব্যবহার করি বেশি। তাই খ্রিস্টীয় নববর্ষ ঘিরেও আমরা অনেক স্বপ্ন বুনি। ফেলে আসা বছরে প্রায় গোটা বিশ্ব একটি দমবন্ধ অবস্থায় কাটিয়েছে। করোনাভাইরাস বিশ্বের মানুষের পুরো বছরের স্বাভাবিক জীবন চলাকে গ্রাস করেছে। এমন জিম্মিদশায় প্রায় গোটা বছরই কেটে গেল বলা যায়। নববর্ষের যদি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা থাকে তো কামনা করব নববর্ষ সে ক্ষমতা প্রয়োগ করুক। পৃথিবীর মানুষ একটি সবুজ-সতেজ জীবনীশক্তি নিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসুক।
পৃথিবীর সব জাতি-ধর্মের মানুষই নববর্ষ ঘিরে আনন্দ উৎসব করে। নানা কামনা-প্রত্যাশা থাকে নববর্ষ ঘিরে। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করে। কোনো বছরই মানুষকে পূর্ণাঙ্গভাবে স্বস্তি দেয় না। অর্থাৎ বছরজুড়ে সবার একই রকম আনন্দময় সময় কাটে না। তাই তারা নতুন বছর থেকে যা কিছু অতৃপ্তি ছিল তা ঘোচাতে চায়। ছোটবেলায় দেখতাম নববর্ষের দিন ভালো খাবারের ব্যবস্থা থাকত। বলা হতো, এতে সারা বছর ভালো খাবার জুটবে। এদিন ঝগড়াঝাঁটি করতে নিষেধ করত। না হলে বছরজুড়েই ঝগড়া করতে হবে। চাকমা সম্প্রদায়ের তরুণীরা বিজু উৎসবের প্রথম দিন ভোরে শুচিশুভ্র হয়ে ফুলের ডালা নিয়ে ঝরনার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। কামনা থাকে সারা বছর সুন্দর জীবন কাটুক। মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই উৎসবে জল ছিটানোর বিশেষ আয়োজন করে। প্রত্যাশা, এই পানির তোড়ে ভেসে যাক বিগত বছরের যত ক্লেদ।
আমাদের তো ২০২০ সালটিতে ক্লেদের অভাব নেই। খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, ঘুষ, দুর্নীতিতে সমাজ যেন আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল। অনেক অন্যায়ের পেছনে লোভী রাজনীতির অপচ্ছায়া ভূমিকা রেখেছে। এসব কারণে মানুষের মধ্যে দমবন্ধকর একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সুবাতাস যে গেল বছরে বয়ে যায়নি তেমন নয়। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অগ্রগতির ঈর্ষণীয় সাফল্য আমরা দেখতে পেয়েছি। অবশ্য সার্বিক মূল্যায়ন করতে হলে এর পেছনে অনেকটা একক কৃতিত্ব ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর দৃঢ়চিত্ততা, দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দুর্দমনীয় সাহস তাঁকে প্রত্যয়ী করে তুলেছে। ফলে কভিড আক্রান্ত দেশেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেনি। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগাপ্রকল্প চূড়ান্ত বাস্তবায়নের পথে। মেট্রো রেলের অগ্রগতিও লক্ষ্য পূরণের দিকে। এ কারণেই আমাদের আফসোস হয় এমন নেতৃত্বের পাশে যদি ঘুষ, দুর্নীতি ও লোভী রাজনীতির সংস্পর্শ কমিয়ে ফেলা যেত, তাহলে নতুন বছরে আমরা শুভ দিনের অগ্রিম আশ্বাস পেতে পারতাম।
তবে শুভ প্রত্যাশা থেকে আমরা সরতে চাই না। দুর্ভোগের অভিজ্ঞতা এ থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে। আমরা দেখেছি ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায়ই বেড়ে ওঠে। সুতরাং উৎসটি যেহেতু জানা আছে, তাই প্রধানমন্ত্রীসহ শুভ চিন্তার রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও সুযোগ রয়েছে সঠিক ও কঠোর নীতিনির্ধারণ করে রাজনীতির ভেতরে অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানো এবং তা চালাতে হবে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, এই আশাবাদী আলোর পথ একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই দেখাতে পারে। কারণ দেশের রাজনীতির অঙ্গনে এখন এই দলেরই সরব অবস্থান। অন্য যেকোনো দলকেই এমন বাস্তব অবস্থায় পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লাগবে। আর শুদ্ধতার কমিটমেন্ট কি এর আগে ক্ষমতায় আসা অন্য কোনো দল দেখাতে পেরেছে? আওয়ামী লীগ নেতারা চাইলে এই সুন্দরের পথে হাঁটতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা হাঁটেননি।
আমরা প্রত্যাশা করব, আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রথমেই দলের ভেতর একটি শুদ্ধতার সংস্কার আসুক। অবৈধ অর্থ উপার্জন ও ক্ষমতার দাপট কমানোর পাশাপাশি উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা এখন জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে তেমন দূরে নন। তাঁরা শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান। লোভ যাঁদের তেমনভাবে পেয়ে বসেনি। এমন মানুষদের আস্থায় এনে এবং অন্ধের মতো দলীয়করণ কমিয়ে ফেলে যদি দৃঢ়তার সঙ্গে নীতিনির্ধারণ করা যায়, তাহলে একটি সুবাতাস বয়ে চলার পরিবেশ তৈরি হবে বলে আমরা মনে করি। নতুন বছরে নেতৃত্বের তেমন প্রত্যয় আমরা দেখতে চাই। প্রবীণ আস্থাশীল নেতৃত্বের পাশাপাশি সুন্দরের স্বপ্ন দেখা নতুন নেতৃত্বের সম্মিলনে দলের ভেতরের স্নায়ুতন্ত্রকে যদি সবল করে দেওয়া যায়, লোভী মানুষদের কোণঠাসা করে ফেলা যায়, তাহলে আমরা অন্য রকম বাংলাদেশ পেতে পারি বলে আমাদের প্রত্যাশা। রাজনীতি শুদ্ধ হলে এর প্রভাব পড়বে সর্বত্র। তাহলে ছাতা থাকবে না বলে ছত্রচ্ছায়াও থাকবে না। এ কারণে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে অন্যায়কারীরা। এর সঙ্গে যদি আইনের শাসন সবল হয়, অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নীতি ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সব ধরনের অনাচার কমিয়ে ফেলা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। নববর্ষে এমন একটি সংকল্প আমাদের দায়িত্বশীলদের মধ্যে সঞ্চারিত হোক আমরা কায়মনোবাক্যে তা প্রত্যাশা করি।
নববর্ষে সাধারণ মানুষকেও শপথ নিতে হবে। আমাদের সবারই দেশের জন্য, সমাজের জন্য আর মানুষের জন্য অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আমরা তা তেমনভাবে পালন করি কি না তা নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে। শক্তির দাপটে, ক্ষমতার দাপটে, অর্থের দাপটে আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে ঠেলে ফেলে এগিয়ে যেতে চাই। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি যদি ভালোবাসা থাকে, তবে আমরা শপথ নিতে পারি সংযত আচরণের, মানবিক হওয়ার। এতে সমাজ অনেক বেশি সুন্দর হবে। শিক্ষাঙ্গনকে সুশৃঙ্খল আর সুন্দর করতে শিক্ষাঙ্গনের অংশীজন এবং সরকারের বিশেষ ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সে দায়িত্ব আমরা অনেক বেশি যৌক্তিকভাবে পালন করি না। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষক যদি তাঁদের পেশার শুদ্ধতা রক্ষা করতে চান, তাহলে ক্লাসরুমে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নেবেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কর্তব্য শিক্ষকতা ও গবেষণা দুটি দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি আমরা সবাই নিজেকে প্রকৃত দায়িত্বশীল মনে করি? নতুন বছরের শুরুতে কি আমরা শপথ নিতে পারি না যোগ্য শিক্ষক হয়ে ওঠার? ক্ষমতাপ্রিয় আমাদের রাজনীতিকরা নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ছাত্ররাজনীতির নামে নৈরাজ্য তৈরির পথ করে দিয়েছেন ক্যাম্পাসগুলোতে। এখন চাইলেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব সময় লাগাম টানতে পারছেন না। কভিডের কারণে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই এ দৃষ্টিতে এক ধরনের কবরের শান্তি রয়েছে ক্যাম্পাসে। তবে এ অবস্থারও তো অবসান হবে। নীতিনির্ধারণ হবে সুস্থ সময়ের বিবেচনায়। আপনারা নতুন বছরের শুরুতে সিদ্ধান্ত নিন, এই অরাজক অবস্থা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেবেন।
সড়কপথে আমাদের ড্রাইভার ভাইয়েরা শপথ নিন, আপনারা দুর্ঘটনা কমিয়ে আনবেন। মানুষ খুনের দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন। মালিকরা সিদ্ধান্ত নিন, সুস্থ গাড়িই আপনারা পথে নামাবেন। ২০২১ হোক নিরাপদ সড়কের বছর।
সমাজ, দেশ ও মানুষকে স্বস্তি দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। দেশে প্রকৃত অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক অস্বস্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যেত। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে এ দেশে কোনো সরকারই সুশাসনের পথে হাঁটেনি, হাঁটছেও না। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছেই আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। স্বাধীনতার পর বর্তমান সময়টিতেই সরকার সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে। এখন চাইলেই সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। পেশার ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনা জরুরি। আজ রাজনৈতিক সরকারগুলো যদি মনে করে, অমুক ক্ষমতাধর পেশাজীবীরা তার সরকার টিকিয়ে রাখতে, নির্বাচনের ক্ষেত্র সুরক্ষা করতে ভূমিকা রাখবে, তাই তাদের পেছনে প্রণোদনার ভাণ্ডার উজাড় করে দেব। আর অন্য নিরীহ অঞ্চলগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করব, তবে তা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দেখা দেবে। এ জন্য আমরা মনে করি, সব অঞ্চল থেকে বৈষম্য কমিয়ে আনা সরকারি নীতি হওয়া উচিত। আমাদের সরকার কি নতুন বছরে সে পথে হাঁটার চিন্তা করতে পারে না!
আমরা সব মিলিয়ে ২০২১-কে শুভ নববর্ষ বলে স্বাগত জানাতে চাই। সবার শুভ ইচ্ছা আর শুভ কর্মে দৃঢ়তা যদি থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা একটি সুন্দর বছরে যাত্রা শুরু করতে পারব। আন্তরিকভাবে চাইব কভিডের মতো সব নষ্ট উৎপাত থেকে মুক্ত হয়ে আমরা যেন একটি শুচি শুভ্র জীবন শুরু করতে পারি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
Discussion about this post