মো. রহমত উল্লাহ্
শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এই মানুষ গড়ার কারিগর যত বেশি যোগ্য হবেন, সুদক্ষ হবেন, ততবেশি যোগ্য নাগরিক পাবো আমরা। তাই তো জীবনের সব পরীক্ষায় অতি উত্তম ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষককে চলায়, বলায়, সাজে, পোশাকে, চিন্তায়, চেতনায়, জ্ঞানে, দক্ষতায়, মেধায়, নীতিতে, আদর্শে, দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবোধে, আধুনিকতায় হতে হয় উত্তম। এসব বিবেচনায় যার উত্তম হওয়ার ইচ্ছা আছে, যোগ্যতা আছে, শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেওয়ার মানসিকতা আছে, তাকে বাছাই করার কাজটি আসলেই কঠিন। আমাদের দেশে শিক্ষক বাছাইয়ের প্রচলিত প্রক্রিয়া কতটা মানসম্মত তা ভেবে দেখা উচিত।
অনেকেই মনে করেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকার কারণেই শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা সম্ভব হয়নি প্রাথমিক শিক্ষার স্তর। সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন বিধিমালায় সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের নিয়োগ যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের সিজিপিএ-সহ স্নাতক বা স্নাতক (সম্মান) বা সমমানের ডিগ্রি। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান পরীক্ষার ফলাফল ন্যূনতম কেমন থাকতে হবে তা ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। তদুপরি এই বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন কোটা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। তাহলে কি এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ বা সমমান প্রাপ্তরাও কোটায় বা অন্য কোনোভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন? এমনটি তো মোটেও হওয়া উচিত নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভালো থাকায় এখন তো ভালো ফলাফলধারী প্রার্থীর কোনও অভাব পড়ছে না। তাই প্রার্থীদের সব পরীক্ষার ন্যূনতম ফলাফল গ্রেড পয়েন্ট ৫-এর মধ্যে ৪.৫ এবং গ্রেড পয়েন্ট ৪-এর মধ্যে ৩.৫ থাকা উচিত। তদুপরি বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক বা বিএড ও এমএড ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার থাকা উচিত। কোনোরকম কোটা সংরক্ষণ করে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়।
এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক বছর আগেও দুটি তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি (সমমান) গ্রহণযোগ্য ছিল। এখনও একটি তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি (সমমান) গ্রহণযোগ্য আছে! যুগ যুগ ধরে আর্থিক সুবিধা কম থাকায়, তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি (সমমান) গ্রহণযোগ্য থাকায় এবং কমিটির হাতে নিয়োগ ক্ষমতা থাকায় এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসেননি বা আসতে পারেননি অধিক যোগ্য শিক্ষক। এক্ষেত্রেও সঠিক হয়নি শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ ও বাছাই। ফলে বজায় থাকেনি শিক্ষার গুণগত মান। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বাছাই ক্ষমতা এনটিআরসিএ’র হাতে নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় কিছুটা অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন সারা দেশে। তথাপি সেই মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখনও এমন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে যাদের সাধারণ জ্ঞান ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা ও প্রায়োগিক ক্ষমতা অত্যন্ত কম এবং তারা জানেন না ও পারেন না অনেক অনেক শব্দের সঠিক বানান ও উচ্চারণ! শ্রেণিকক্ষেও পরিহার করতে পারেন না আঞ্চলিক ভাষা! সঠিক পাঠদান তো অনেক দূরের কথা!
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রায় ৯৭ ভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শতভাগ গুণগত শিক্ষা প্রত্যাশা করা মোটেও উচিত নয়। বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ মূল বেতন দিয়ে থাকে সরকার। যদিও এটি কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। তথাপি এনটিআরসিএ’র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে দেখা যায় লাখ লাখ অধিক যোগ্য প্রার্থী বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করে থাকেন। তাই কোনও পরীক্ষায় গ্রেড পয়েন্ট ৫-এর মধ্যে ৪.৫-এর কম পেয়েছে এবং গ্রেড পয়েন্ট ৪-এর মধ্যে ৩.৫-এর কম পেয়েছে এমন কোনও প্রার্থীকে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। তদুপরি ন্যূনতম বিএড ডিগ্রিধারী হওয়া আবশ্যক অথবা বিএড ও এমএড ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক। অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকগণের সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা। কেননা, অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী তৈরির জন্যই শিক্ষককে হতে হবে সর্বোচ্চ যোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের প্রথম সারির একটি বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গত ১২ অক্টোবর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, প্রভাষক হওয়ার ক্ষেত্রে এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় গ্রেড পয়েন্ট ৫-এর মধ্যে যেকোনও একটিতে ন্যূনতম ৪.০০ এবং অন্যটিতে ন্যূনতম ৪.৫০ নির্ধারিত আছে। সেই সাথে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় গ্রেড পয়েন্ট ৪-এর মধ্যে উভয়টিতে ন্যূনতম ৩.৫ নির্ধারিত আছে। যেখানে প্রতিবছর এসএসসি/সমমান পরীক্ষায় লক্ষাধিক এবং এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় অর্ধলক্ষাধিক জিপিএ-৫ পেয়ে থাকে সেখানে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য এর চেয়ে কম যোগ্যতা নির্ধারণ করা মোটেও উচিত নয়। অন্যান্য পর্যায়ের/ক্ষেত্রেও রয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণে অনেক শিথিলতা। এই শিথিলতার মাত্রা আবার একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম। তাছাড়া অনেক বাছাই পরীক্ষা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। অর্থাৎ সর্বোচ্চ পর্যায়েও শতভাগ সঠিক হচ্ছে না শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ ও বাছাই। হয়তো তাই আজ আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক পেছনে। যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই নির্ধারিত থাকা উচিত সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সর্বাধিক ভালো ফলাফল। সেই সাথে বাধ্যতামূলক বা অগ্রাধিকার গণ্য থাকা উচিত বিএড বা এমএড ডিগ্রি এবং অন্যান্য যোগ্যতা।
আলোচিত প্রতিটি স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই আরও উন্নত করতে হবে শিক্ষক বাছাই প্রক্রিয়া। সকল স্তরেই বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বাছাইয়ে মূল্যায়ন করতে হবে আরও অনেক বিষয়। উন্নত বিশ্বে শিক্ষক হওয়ার আবেদন করার জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি এডুকেশনে ন্যূনতম ব্যাচেলর ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একই বিধান। এমনকি অন্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি থাকলেও এডুকেশনে ব্যাচেলর ডিগ্রি না থাকলে কেউ শিক্ষক হতে পারবেন না। তিনি যে বিষয়ে অনার্স/ মাস্টার্স/ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করেছেন বলেই শিক্ষক হয়ে যাবেন এমন সুযোগ নেই। হতে পারেন তিনি সে বিষয়ের উত্তম ছাত্র, শিক্ষক নন। শিক্ষক হতে হলে অবশ্যই তাকে পৃথকভাবে শিখতে হবে শিক্ষকতা। অর্জন করতে হবে এডুকেশনে ন্যূনতম ব্যাচেলর ডিগ্রি। তার আগেই দেখতে হবে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। কেউ যদি গণিতের শিক্ষক হতে চান তো গণিতে ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি এডুকেশনেও ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। তদুপরি ফেস করতে হবে লং মকটেস্ট ও ভাইবা। সব দিক থেকে যোগ্য বিবেচিত হলেও নিয়োগ হবে সাময়িক। ভালো পারফর্ম করবে তো থাকবে, খারাপ পারফর্ম করবে তো থাকবে না। অথচ আমাদের দেশে থার্ড ক্লাস/ ডিভিশন পেলেও, আর কিছুই না হোক, শিক্ষক হওয়া যায়! এর জন্য পৃথক কোনও স্বপ্ন লাগে না, শিক্ষা লাগে না! হুজুর হওয়া তো আরও সহজ! আমরা ভেবেও দেখি না শিক্ষকতার ডিগ্রিবিহীন থার্ড ক্লাস শিক্ষক দিয়ে কীভাবে তৈরি হবে ফার্স্ট ক্লাস নাগরিক!
আমি জানি, অনেকেই বলবেন, উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অনেক বেশি। হ্যাঁ, একথা অবশ্যই সঠিক, আমাদের দেশের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম; যা বৃদ্ধি করা জরুরি। আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক-কর্মী তৈরি করার জন্য অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে আমাদের শিক্ষার মান। শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যই নিয়োগ করতে হবে সর্বাধিক যোগ্য শিক্ষক, বাড়াতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। সেই সাথে করতে হবে বিদ্যমান সুবিধার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার। পর্যাপ্ত প্রার্থী থাকায় বর্তমান স্বল্প সুবিধার মধ্যেও শুরু করা সম্ভব আরও অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া। সেজন্য পুনর্নির্ধারণ করতে হবে সর্বস্তরে শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অগ্রাধিকার (শিক্ষকতার জন্য মূল বিষয়াদির পাশাপাশি শিক্ষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু করা হলে কয়েক বছর পরেই আর অভাব হবে না এই ডিগ্রিধারী প্রার্থীর। যারা শিক্ষক হতে চান তারা অনেক আগে থেকেই মনেপ্রাণে লালন করবেন শিক্ষকতা পেশাকে এবং যে বিষয়ের শিক্ষক হতে চান সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি অর্জন করবেন শিক্ষায় ব্যাচেলর ডিগ্রি)। তদুপরি শিক্ষক বাছাইকালে অবশ্যই প্রার্থীদের অংশগ্রহণ করাতে হবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। যেন মূল্যায়ন করা যায় তাদের লেখার, বলার ও পাঠদানের দক্ষতা। চিহ্নিত করা যায় উত্তরণের অযোগ্য দুর্বলতা। সবাই সব কাজের যোগ্য হবেন না এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অতি দুর্বলকে বারবার প্রশিক্ষণ দিয়েও কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত করা সম্ভব হয় না। একজন অযোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অসংখ্য অযোগ্য নাগরিক-কর্মী। হয়তো সঠিক যোগ্যতার অভাবে নিজের অজান্তে, অনিচ্ছায় আমিও করছি তাই। শিক্ষক অযোগ্য হলে, সাধারণের অজান্তে সমাজের সর্বত্র তৈরি হয় গভীর ক্ষত, জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি!
লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
Email: rahamot21@gmail.com
Discussion about this post