আবদুস সেলিম
করোনা-ক্রান্তি বিশ্ব-জীবনযাত্রার এমন কোনো স্তর নেই যাকে তার অশনি-বলয়ের স্পর্শে তছনছ করেনি, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক দুঃসহ সময় যা অনন্তকাল বারবার মনে করিয়ে দেবে এক ভুল প্রতিযোগিতার দৌড়ে তারা মেতে ছিল আর সেটা হলো শক্তি-প্রতিযোগিতা এবং একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের কৌশল প্রণয়ন। করোনা, আমাদের সভ্যতাকে স্পষ্ট শিক্ষা দিয়েছে মানুষ হাজার বছর ধরে ভুল পথে চলেছে, শিক্ষাকে ব্যবহার করেছে মানবকল্যাণের চেয়ে মানব ধ্বংসের কাজে। প্রকৃতি এখন তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিংবা বলা যায় মানুষ তার ভ্রান্ত ধারণার খেসারত দিচ্ছে।
২
পরিসংখ্যান বলে সারা বিশ্বে অস্ত্র-সংঘর্ষ, বাধ্যতামূলক উচ্ছেদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ পরিবর্তন দীর্ঘায়িত সংকটের জন্ম দেয় যার ফলে পঁচাত্তর মিলিয়ন শিশু-কিশোর নিয়মিতভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে। আর এ সংখ্যা এখন অভাবিতভাবে ঊর্ধমুখী কোভিড ১৯-এর প্রকোপে। জাতিসংঘের হিসাবে জানা যায় সারা বিশ্বে সাতটি মহাদেশের ১৯০টি দেশে ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলকভাবে এ মুহূর্তে শিক্ষাবঞ্চিত হয়ে আছে শুধু করোনা প্রকোপের কারণে। অতিমারি বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় এক বছরকাল বন্ধ করে রাখতে বাধ্য করেছে। ফলে শতকরা নিরানব্বই ভাগ শিক্ষার্থীই শিক্ষাহীন অলস সময় কাটাচ্ছে। এর ফলে সব দেশেরই শিক্ষাব্যবস্থায় আগে থেকেই যে বৈষম্য বর্তমান ছিল তা এক সংকটাপন্ন স্থানে পৌঁছে গেছে। সব চেয়ে আক্রান্ত সম্প্র্রদায় হলো দরিদ্র গ্রামীণ পরিবেশে যাদের বসবাস, যাদের অধিকাংশই মেয়ে-শিশু, শরণার্থী, প্রতিবন্ধী এবং বাধ্যতামূলক উচ্ছেদকৃত জনগোষ্ঠীর সন্তানসন্ততি। বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি কমবেশি বর্তমান।
করোনার কারণে এ শিক্ষা-বঞ্চনা বা ব্যাঘাত দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই যার ফলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দারুণভাবে ব্যাহত হবে, কারণ আমি আগেই বলেছি শিক্ষাই প্রক্রিয়াগতভাবে উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি সহায়ক- যার প্রত্যক্ষ উদাহরণের অভাব নেই। জাতিসংঘ বলছে করোনার কারণে আগামী বছর অতিরিক্ত ২৩.৮ মিলিয়ন শিশুকিশোর, প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ছিটকে পড়বে অতিমারির আর্থিক অভিঘাতে। এ কথা বাংলাদেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জন্যগোষ্ঠীর জন্য একটি সর্বনাশা ইঙ্গিত। এ কারণে এ জন্যগোষ্ঠীর সন্তানাদিরাই শিক্ষার আলোকে সমর্থ হয়ে সামাজিক সচলতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সর্বাপেক্ষা আগ্রহী এবং নেয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার এ ব্যাঘাত অন্য অনেক অশুভ বিষয়কে উৎসাহিত করতে পারে, যেমন- পিতা-মাতা-অভিভাবকদের বাধ্যতামূলক আয়-সংকোচ তাদের সন্তান-সন্ততিদের যথেষ্ট খাবার সরবরাহ ক্ষমতা শিথিল করতে পারে, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সংসারের উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে স্থায়ীভাবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সরে যেতে পারে এবং সময়ে প্ররোচিত হয়ে অপরাধ জগতের কালো হাতছানিতে দারুণভাবে আকর্ষিত হতে পারে। এ ছাড়া বেশকিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সত্যসন্ধানী গবেষণায় দেখা গেছে কোভিড মহামারি অনেক দরিদ্র পরিবারের ব্যয় সংকোচনের জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলগামী মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য করছে। আর একটি বিষয় হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে, মহামারির কারণে যেহেতু রাষ্ট্রীয় আয় সংকোচিত হবে এবং সেই সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হবে, ভবিষ্যতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দও সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এরই সঙ্গে রয়েছে ভবিষ্যতের ভাবনা- অর্থাৎ কোভিড পরবর্তী শিক্ষা কেমন হবে বা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহামারিকালে শিক্ষাক্রমে অনেক নতুন-নতুন রীতি-পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হয়েছে উন্নত এবং উন্নতশীল উভয় দেশেকেই, বাংলাদেশকেও। যেখানে দূর-শিক্ষণ পদ্ধতির ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে শিক্ষক ও প্রশিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে, যার সঙ্গে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষক-প্রশিক্ষার্থীর কোনো সংযোগ ছিল না। এর জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের অভাব তো ছিলই বা এখনো আছে। কিন্তু তার চেয়ে হতাশাব্যঞ্জকভাবে আছে প্রযুক্তিতে প্রবেশগম্যতার অপ্রতুলতা। ভার্চুয়াল পাঠক্রম ও পাঠদান পদ্ধতির সমস্যা সমাধানে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তাতে সম্পূর্ণ সমস্যার সমাধান হয়নি কোনোক্রমেই। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে। এ ছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষাদান সঠিকভাবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে সব ছাত্রের জন্য পরিচালনা করতে পারছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে এসব ছাত্রের বিশাল একটি অংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের এবং গ্রামে বসবাস করে, যেখানে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের অপ্রতুলতা মারাত্মক। ভবিষ্যতের শিক্ষা পরিকল্পনা ও নীতিমালায় এসব বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়া উচিত কারণ আমাদের এক নতুন-স্বাভাবিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রায় এক বছরের মহামারির কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের বিশাল এক জমা কাজ পড়ে রয়েছে যার অন্যতম হলো গতবছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এবং এ বছরের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। তা ছাড়া রয়েছে করোনার কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন্ন সম্ভাব্য সেশন সমস্যাও জট যার ফলে অনেক ছাত্রছাত্রী তাদের পরিকল্পিত পেশা এবং উচ্চশিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকবে এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো তাদের জীবনের লক্ষ্যই অর্জন করতে পারবে না।
বাস্তবাতার আর একটি অমোঘ বিষয় হলো অনেক তরুণ-তরুণী তাদের শিক্ষা-খরচ চালায় খণ্ডকালীন চাকরি করে কিংবা টিউশনি করে। মহামারি তাদের অধিকাংশকেই নির্মমভাবে বেকার করে দিয়েছে। ফলে তাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় অনেক সদ্য ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীই আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত চাকরি বাজারের কারণে নিয়োগ পাচ্ছে না। ফলে তারা এক হতাশার জীবনযাপন করছে এবং শিক্ষার ওপর আস্থাহীনতার শিকার হচ্ছে। পারিবারিকভাবেও তাদের অনেককে এক বিশাল বোঝা হিসেবে বিবেচিত হতে হচ্ছে এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও প্রীতির সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
৩
কোভিড-১৯ যেমন আমাদের অনেক সমস্যাতে ফেলেছে তেমনি সে সমস্যা থেকে নতুন অনেক কিছু শিখতেও সাহায্য করেছে যা আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয় হিসাবে থেকে যাবে। এর অন্যতম হলো দূরশিক্ষণের এক বিশাল হাতিয়ারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সেগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া। বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার কথা আমরা বেশ কিছুদিন থেকে শুনছি কিন্তু সত্যিকার সংকট এর অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট করেছে। এরই সঙ্গে যেসব শিক্ষার্থীর আওতায় এসব প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নেই তাদের কীভাবে এর আওতায় আনা যায় সেসব নিয়েও ব্যবহারিক বুদ্ধি-গবেষণা চলছে। আঞ্চলিকভাবে এমন অনেক সমাধান সম্ভব বলে প্রযুক্তি-গবেষকরা মনে করেন। এর সঙ্গে শিক্ষকদেরও এক বিশাল ভূমিকা আছে যাদের প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করতে সরকারি বা সংস্থাগত সাহায্য প্রয়োজন। দেশের আগামী শিক্ষা পরিকল্পনা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় এসব বিষয় স্থান পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
শিক্ষা ক্ষেত্রে কোভিড ১৯-এর অশুভ প্রভাব সীমাহীনভাবে অনুভূত হচ্ছে। আমরা যে অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। সারা বিশ্বের শিক্ষাকর্মকে এ অতিমারি নিঃসন্দেহে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ কথাও ঠিক শিক্ষা পরিবার সম্মিলিতভাবে এ ক্ষতিকে শুধু প্রতিরোধ নয় পেছনের ক্ষতিকে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিহাস বলে প্রতিটি মানব-বিপর্যয়ের পরই মানবজাতি এক লড়াকু মনভাব নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে আশাপ্রদ ভবিষ্যতের দিকে এগোতে থাকে। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমনি এক আশাজাগানিয়া ভবিষ্যতে পৌঁছাতে পারব নিশ্চিতভাবে কারণ আমাদের অসীম অন্তর্গত প্রচেষ্টাশক্তি আছে।
করোনা-ক্রান্তিই জোগাক আমাদের ওই অমঙ্গল-বলয় ধ্বংসের হাতিয়ার, বোধ দিক আমরা যেন আবার কোনো ভুল প্রতিযোগিতার দৌড়ে মেতে না উঠি।
লেখক : অনুবাদক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
Discussion about this post