গোলাম সারওয়ার
ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। সংক্ষেপে ড. জোহা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী তিনি। তাঁর আত্মত্যাগ স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মহান শিক্ষককে পাক সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে র্নিমমভাবে হত্যা করে। তাঁর এই হত্যার খবর প্রচারিত হবার সাথে সাথে দেশের সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
রাজশাহীসহ সারাদেশের মানুষ গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। কারফিউ অগ্রাহ্য করে ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে। তারই পরিণতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।ছয় দফার আন্দোলন,বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনুসারিদের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা,সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ড. জোহাকে হত্যা এবং গণঅভ্যুত্থান কোনটাকেই বিচ্ছিন্ন করে দেখবার উপায় নেই। এই গণঅভ্যুথ্বানের পথ ধরেই আমাদের অবর্তীণ হতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। তাই ড. জোহার প্রয়াণ দিবস ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয দিন।
মুজিব বর্ষের প্রাক্কালে ড. জোহার আত্মত্যাগকে আমরা গভীরভাবে স্মরণ করি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাখে ড. জোহার আদশ একই সূত্রে গাথা। বঙ্গবন্ধুর মত তিনিও ছিলেন দৃঢ়চেতা, বলিষ্ঠ, অকুতোভয় এবং দেশপ্রেমিক। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে ছাত্রদের জীবন রক্ষা করেছিলেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবাদ সভায় তিনি বজ্রগভীর কণ্ঠে উচ্চারিত করেছিলেন, “এরপর যদি কোন গুলি করা হয়,সে গুলি কোন ছাত্রের গায়ে লাগবার আগে আমার বুকে লাগবে।” পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে হাজার হাজার বিক্ষোভরত ছাত্রদের জীবন রক্ষা করে ববর পাক সেনাদের গুলি এবং বেয়নেটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তক্ষরণে নিহত হন।প্রথম একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিহত হওয়ার ঘটনা সারাদেশে বিদ্যুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে।সবস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কারফিউ উপেক্ষা করে রাজশাহীসহ ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে।গণঅভ্যুত্থানের উজ্জ্বল শিখা হয়ে ওঠেন ড. জোহার আত্মবলিদান। যার পথ ধরেই আমাদের অবতীর্ণ হতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করেছিল তাঁর এই মৃত্যু। অথচ তাঁর দেশের জন্য মহান এই ত্যাগের মূল্যায়ন আমরা আজ পযন্ত করতে পারিনি। বড় অকৃতজ্ঞ এ জাতি!
ড. জোহা ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধসম্পন্ন শুধু একজন আদর্শ শিক্ষক নন, তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক।
প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে “জোহা দিবস” হিসেবে পালিত হয়।এখানে তাঁর্ নামে ছাত্রদের একটি হল আছে। তাঁর সমাধিস্থল ঘিরে প্রশাসন ভবনের সামনে চক্রাকার একটি চত্বর আছে। ২০০৮ সালে রাষ্ট্র তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে এবং তাঁর নামে একটি স্মরক ডাক টিকিট প্রকাশ করে দায় সেরেছে।এটাই কী তাঁর অবদানের মূল্যায়ন?
এমন একজন মহান শিক্ষকের আত্মত্যাগের কথা আগামি প্রজন্ম জানবেনা, এটা কী করে হয়? এ কেমন দেশ, এ কেমন সরকার! পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রদের জন্য শিক্ষকের প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা বিরল। দেশপ্রেমের এই চেতনা ছড়িয়ে দেবার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া উচিত। ড. জোহার রক্তের ডাক, ছাত্রদের প্রতি দায়িত্ব ও কতব্যবোধের যে অণুকরণীয় দৃষ্টান্ত, তা উজ্জীবিত রাখার জন্য আমরা রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. জোহার প্রতি সন্মান প্রদশন করে, তার রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে “জাতীয় শিক্ষক দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
যদিও ২০০৩ সালে ১৯ জানুয়ারিকে তৎকালীন সরকার ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে চালু করে,কিন্তু একজন মহান শিক্ষকের,স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত রচনাকারির অবদানকে অবমূল্যায়ন করে এই দিবস ঘোষণা করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে,তা জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখলাম। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত একজন শিক্ষক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞান,যিনি ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাঁকে সন্মান প্রদশন করে, তার জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে সে দেশে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। এইভাবে অনেক দেশ নিদিষ্ট একজন শিক্ষকের অবদানকে স্মরণ করে জাতীয় শিক্ষক দিবস পালন করে। আর আমাদের দেশে ‘ছাত্রদের জন্য শিক্ষকের জীবন দেওয়ার মত বিরল ঘটনাকে উপেক্ষা করে চলেছি।
বর্তমান ক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার।তাছাড়া চলছে “মুজিববষ”। জাতির এই শুভক্ষণে ড. জোহার নক্ষত্রের মত অবদানকে স্মরণ করে ১৯ জানুয়ারির পরিবতে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে “জাতীয় শিক্ষক দিবস” ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের এবং আদশ শিক্ষকের মহান অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাই।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post