সোহানা আফরীন
মানুষ একা চলতে পারে না বলে সে সমাজ তৈরি করে নেয়। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারী একদল লোক যখন পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে অভিন্ন জীবন-প্রণালি এবং সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখনই সমাজ গঠিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী গিডিংসের ভাষায় সমাজ হলো- ‘A number of likeminded individuals, who know and enjoy their like mindedness and are therefore able to work together for common ends.’
শিক্ষার ওপর সমাজের প্রভাব
ব্যক্তি ও সমাজ ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ। ব্যক্তি সমাজ গঠন করে; কিন্তু সেসব দিক দিয়ে সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিতও হয়। সমাজের সদস্য হিসাবে ব্যক্তি যে আদর্শ ও ঐতিহ্য ধারণ করে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। সেই ব্যক্তি প্রকৃত শিক্ষিত, যে সামাজিক আদর্শকে ধারণ ও লালন করে।
এভাবে পরিবার, বিদ্যালয়, রাষ্ট্র ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুর শিক্ষায় প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি সচেতন এবং অবচেতনভাবে তার পরিবেশ তথা সমাজ থেকে যা কিছু শেখে, তা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান হিসাবে কাজ করে।
এভাবে শিক্ষার পুরোপুরি অধিকাঠামোই সমাজের প্রয়োজন ও চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। কোনো সমাজের সব আকাঙ্ক্ষা ওই সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। তাই শিক্ষাকে কোনোভাবেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না।
এ প্রসঙ্গে ক্লার্ক যথার্থই বলেছেন-‘শিক্ষা বিষয়ের কোনো লেখক শিক্ষা সম্পর্কে সর্বজনীন ধারণা বিকাশের যতই চেষ্টা করুন না কেন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তা করা সম্ভব নয়।’
ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা একটা সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজের চাহিদামাফিক সদস্যদের উন্নয়নে সহায়ক কার্যক্রম প্রণয়ন করাই হলো শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষার কাজ কেবল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিবর্তন নয়; সমাজের প্রত্যাশিত রীতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর কাজ, চিন্তা, অভ্যাস, দক্ষতা, আগ্রহ ও মনোভাবের পরিবর্তন আনয়নও শিক্ষার লক্ষ্য।
সুতরাং শিক্ষা ও সমাজকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না; বরং শিক্ষাকে সমাজের চাহিদা ও আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। এ প্রসঙ্গে একেসি ওটাওয়াইয়া বলেছেন- ‘Education is an activity which goes on in a society and its aims and methods depend on the nature of the society in which it takes place.’
এ কারণে শিক্ষাক্রম এবং কোনো শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণের আগে শিক্ষার বিভিন্ন সামাজিক উদ্দেশ্য বিবেচনা করা প্রয়োজন হয়। এসবের মধ্যে প্রধান সমাজের অবস্থা, সমস্যা ও চাহিদা; শিক্ষার্থীর চাহিদা ও সমস্যা; সমাজের মৌলিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ; সমাজ উন্নয়নে সহায়ক ও দায়িত্বসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি; সমাজের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়ন; সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ী বৃত্তির সুযোগ সৃষ্টি এবং এগুলোকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান; মানবিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে সহায়ক মনোভাব তৈরি; শিশুকে সমাজের জন্য প্রস্তুত করা; সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি; সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা নবায়ন ও যুগোপযোগীকরণ এবং শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে সমষ্টিগত ধারণার বিকাশ সাধন।
সমাজের ওপর বিদ্যালয়ের প্রভাব
বিদ্যালয় সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। শিশুর শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত না হলে শিশুর শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা অসম্ভব। তাই বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাজের স্বার্থেই পরিচালিত হতে হবে এবং বিদ্যালয় হবে সমাজের প্রতিনিধি। এ কারণে জন ডিউই ‘বিদ্যালয়কে একটি সমাজ’ বলে অভিহিত করেছেন; অর্থাৎ বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হবে।
বিদ্যালয় সমাজ উন্নয়নের অপরিহার্য অঙ্গ। তাই বিদ্যালয়কে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে হবে না। এ ছাড়া শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব একক বিদ্যালয় বা সমাজের পক্ষে পরিচালনা করাও সম্ভব নয়। উভয়ের মাঝে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই শিশুর শিক্ষা যথাযথভাবে পরিচালিত হতে পারে।
এ উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় একদিকে যেমন সামাজিক চাহিদার ভিত্তিতে শিক্ষা কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবে, অন্যদিকে সমাজেরও কর্তব্য বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনমাফিক সহায়তা প্রদান করা। বিদ্যালয় ও সমাজকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হলে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
যেসব উপায়ে তা করা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-স্থানীয় লোকজনের চাহিদা চিহ্নিত করে যতটা সম্ভব বিদ্যালয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা পরিপূরণের ব্যবস্থা করা; বিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্মকাণ্ডে সমাজের সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা বিদ্যালয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা; স্থানীয় সম্পদ (যেমন-কৃষিজমি, কল-কারখানা, দোকান, বাগান, গবেষণাগার ইত্যাদি)কে বিদ্যালয়ের কাজে লাগানো; বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সেবা যতটা সম্ভব বিদ্যালয়ের কাজে লাগানো; বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম সামাজিক চাহিদাকে ভিত্তি করে গড়ে তোলা; শিক্ষার্থীদের স্থানীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত করানো; বিদ্যালয় এলাকায় সবাইকে স্বাক্ষর করার দায়িত্ব বিদ্যালয়েরই নেওয়া এবং বিদ্যালয় ও অভিভাবকের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা।
সমাজের কিছু দায়-দায়িত্ব
আজকের এই গণতান্ত্রিক যুগে বিদ্যালয়কে যেমন সমাজের কাছে নিয়ে আসা প্রয়োজন; তেমনি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রয়োজনে সমাজেরও কিছু শিক্ষামূলক দায়িত্ব আছে। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর মানসিক উন্নয়ন। এ জন্য লেখাপড়া ছাড়া শিক্ষার্থীদের আরও কিছু দিকের উন্নয়ন প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক খেলার মাঠ, পার্ক, জিমনেসিয়াম, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
সমাজের দায়িত্ব এসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ সুসংহত করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। তা ছাড়া নাগরিকের নৈতিকতার ওপরও সমাজের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা, উদার মনোভাব, সহিষ্ণুতা, কর্তব্যপরায়ণতা ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের নৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের সমাজের সহযোগিতা ছাড়া এ দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। সুতরাং সমাজের অন্যতম দায়িত্ব শিক্ষার্থীর জন্য উপযুক্ত নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। পরিবার এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে এ উদ্দেশ্যে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ। সমাজ জীবনে এটি একটি পক্ষাঘাতের মতো। নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ গৃহীত হলেও এর কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে সমাজের ওপর। সুতরাং সমাজের জন্য দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদ তৈরি করা জরুরি বিষয়।
এ ছাড়া প্রত্যেক সমাজের একটি আদর্শগত অবস্থান থাকে। একে সমুন্নত রাখা সমাজের দায়িত্ব। উন্নত আদর্শ নাগরিকদের মধ্যে সততা, শ্রমের মর্যাদা, আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মনির্ভরশীলতা সৃষ্টিতে সহায়ক। সমাজ এগুলো সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
শিক্ষার একটি প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌন্দর্য উপভোগের মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। সমাজ শিল্পকলা, অঙ্কন, সংগীত ইত্যাদি চর্চার সুযোগ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারে। এভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যখন সৌন্দর্যবোধ গড়ে উঠবে, তখন সে পরিবারে এবং সমাজে নোংরামি ও পঙ্কিলতাকে প্রশ্রয় দিবে না। এভাবে সমাজে সুস্থ ও সুখী পরিবেশ গড়ে উঠবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশেও সমাজের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
একজনের ধর্মীয় অনুভূতি যেন অন্যজনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে এবং ধর্ম যেন গোঁড়ামিতে পরিণত না হয়, তা দেখার দায়িত্ব সমাজের। সমাজ নাগরিককে শিক্ষা দেবে সব ধর্ম সমান এবং সবাই যেন নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে, সেটি দেখার দায়িত্বও সমাজের।
শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য শিশুকে সামাজিক করে গড়ে তোলা। শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের পরে সমাজের ভূমিকা মুখ্য। সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাভাবে এ দায়িত্ব পালন করে। বিদ্যালয় সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। সুতরাং বিদ্যালয়সহ সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সামাজিকীকরণের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। সমাজ পরিবর্তনশীল। সৃষ্টির শুরু থেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ বর্তমান স্তরে পৌঁছেছে এবং আগামীতে তা অব্যাহত থাকবে।
একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসাবে শিক্ষার কাজ হলো সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত করা। শিক্ষার প্রভাবে সামাজিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। ব্যক্তির বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ করে দিয়ে এবং ব্যক্তির আচরণ, মূল্যবোধ, সামাজিক আদর্শ, বিশ্বাস, মনোভাব এবং সম্পর্কের স্তরবিন্যাস ইত্যাদির পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনকে গতিশীল করে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষা প্রক্রিয়া সরাসরি সামাজিক পরিবর্তনে সহায়তা করে না। ব্যক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। তবে সামাজিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষা প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তি সামাজিক আদর্শ ও ঐতিহ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আজকের শিশু আগামী দিনে জাতির নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং তাদের জন্য প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করা সমাজের দায়িত্ব। বিদ্যালয় ও সমাজের সহযোগিতার মাধ্যমে শিশুর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। শিক্ষা ও শিক্ষাক্রম অবশ্যই সমাজের প্রয়োজনমাফিক পরিচালিত হবে।
অন্যদিকে সমাজের দায়িত্ব হলো শিক্ষা-সহায়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং শিক্ষার সহায়ক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা। এভাবেই শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনে ও উন্নয়নে সহায়ক হবে।
সোহানা আফরীন : গবেষণা সহযোগী, হোমিং ফর এডুকেশন অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, ঢাকা
Discussion about this post