ড. আর এম দেবনাথ
‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ ছোটবেলায় গুরুজনদের কাছে এ কথা বহুবার শুনেছি। শুনে শুনে গর্ববোধ করেছি। কিন্তু একটু বড় হতে না হতেই মনে প্রশ্ন জাগা শুরু করে। মাছে-ভাতে যদি বাঙালি হয়, তাহলে এত ভিক্ষুক কেন? গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে গরিব মানুষের ভিড়, কাজের জন্য, দুটো ভাতের জন্য। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস, চৈত্র-বৈশাখে দ্বারে দ্বারে মানুষ ভিক্ষা করছে। চাল নয়, ভাতের মাড়ের জন্য। আরেকটু বড় হয়ে শুনেছি উত্তরবঙ্গের ‘মঙ্গার’ কথা, যেখানে ভিক্ষা করে দুমুঠো চাল মিলে না। মানুষের গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতা নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, ছনের ঘর, মাটির ঘর। দারিদ্র্য দেখতে দেখতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-১৯৭১ সাল। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি, জাতির পিতার শতবর্ষ পালনকালে কী মনে হয়? এখন কি ভাতের অভাব আছে? ২০২০ সাল গেছে কর্মহীন অবস্থায়-করোনার আক্রমণ। মানুষ কি না খেয়ে মরেছে? না, তা হয়নি। এখন ভাতের অভাব নেই, নেই মাছেরও অভাব। মাছে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতাপূর্বকালের তুলনায় চালের উৎপাদন চারগুণ বেড়েছে। শাকসবজি, ফলমূলের অভাব নেই। ‘মঙ্গা’! ‘মঙ্গা’ শব্দ আমাদের কাছে এখন একটি অপরিচিত শব্দ। মানুষের গায়ে একটা জামা আছে, গেঞ্জি আছে। পায়ে জুতা আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এসব তথ্য কী বলে? বলে,আমাদের অর্জন বিশাল। মানুষ খেয়ে-পরে আছে-এত বিশাল খবর।
১৯৭২-৭৩ সালে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ কোটি ডলার। আজকে কত? ৪৪-৪৫ বিলিয়ন ডলার। দিন দিন এর পরিমাণ বাড়ছে। ডলারে ডলারে সয়লাব। বস্তুত অতিরিক্ত ডলার অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে। যে এক-দেড় কোটি বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত; তাদের পাঠানো ডলার/টাকায় গ্রামবাংলা আজ সম্পূর্ণ নতুন সাজে সেজেছে। গ্রামে গ্রামে ক্যাশের কোনো অভাব নেই। রেমিটেন্স প্রাপকরা তাদের ঘর-বাড়ি পাকা করছে। পানীয় জলের জন্য টিউবওয়েল বসাচ্ছে। স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃব্যবস্থার আয়োজন করেছে। সেচের জলের জন্য মেশিন বসাচ্ছে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণের জন্য নানা যন্ত্রপাতি ক্রয় করছে। গ্রামে গ্রামে নতুন নতুন পেশার জন্ম হচ্ছে। পুরোনো বহু পেশা মারা যাচ্ছে। নতুন নতুন পেশায় তরুণরা নিয়োজিত হচ্ছে। মোটরসাইকেলে তরুণরা মানুষজনকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। বাসের প্রয়োজন কম। ১০-১৫-২০ মাইল দূরে রাতের দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফেরা যাচ্ছে ছেলেমেয়েসহ। গ্রামে গ্রামে হাট, উপজেলায় বিশাল বিশাল দোকান-যেন মিনি ঢাকা। ঢাকায় যা পাওয়া যায়, ওইসব বাজারে তা পাওয়া যায়।
দোকানিরা এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন মোকামে, পাইকারি দোকানে আর আসে না। পাইকাররা দোকানে দোকানে মাল পৌঁছে দেয়। মুহূর্তে বাজার দর পাওয়া যায়-মোবাইলে মোবাইলে অর্ডার, মোবাইলে মোবাইলে টাকা পরিশোধ। কোনো ঝুঁকির ব্যাপারই নেই। স্বর্ণের দোকান রাতের বেলায় ঝকঝক করে। মহিলারা পর্যন্ত রাতের বাজার করে। উপজেলায় উপজেলায় হাইস্কুল, কলেজ, মহিলা কলেজ। আমাদের সময়ে জেলা শহর ছাড়া কলেজ ছিল না। ‘লজিং’ থেকে পড়াশোনা করতে হতো। এখন বাড়িতে থেকে কলেজ, স্কুল সব করা যায়। মেয়েরা লেখাপড়ায় অগ্রগামী। ছেলেদের তুলনায় তাদের স্কুলে ভর্তির হার বেশি। তাদের পরীক্ষার ফলও ভালো। তারা উপজেলা শহরে নানা বৃত্তিমূলক কাজ করে। গ্রামের সম্ভ্রান্ত লোকেরা, অবস্থাপন্ন লোকেরা এখন উপজেলা শহরে। এখানে সুযোগ-সুবিধার অভাব নেই। ৫০ বছরে বিশাল পরিবর্তন। গ্রাম চেনা যায় না। আমরা ঢাকায় আসতাম সারা দিন লাগত, ৬০ মাইল দূরত্ব পাড়ি দিতে। এখন ২ ঘণ্টায় বাড়ি যাওয়া যায়। একটি রাস্তার স্থলে তিনটি রাস্তা। বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে ঢাকা থেকে এখন যেতে লাগে ৫-৬-৭ ঘণ্টা। আরামদায়ক জার্নি। দেশের দক্ষিণাঞ্চল একটু পেছনে ছিল। পদ্মা সেতু নিজ ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গ হবে সুখী-সমৃদ্ধ একটা অঞ্চল। ঢাকা থেকে ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা হবে মুহূর্তের ব্যাপার।
পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামে কুপিবাতি জ্বলত না। মানুষ সন্ধ্যার আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আজ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আমাদের। বিদ্যুৎ গ্রামীণ জীবনকে বদলে দিচ্ছে। যে বাঙালি ব্যবসা জানত না, সে আজ আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করে, গ্রামীণ ব্যবসা গড়ে তুলেছে। নতুন জীবনধারণের স্টাইল। আমরা চা রপ্তানি করতাম, এখন সবাই চা খায়-অতএব চা আমদানি করতে হয়। কেউ আটার রুটি খেতে চাইত না। আজ আটার রুটি সবার নাস্তার জন্য লাগে। তরুণরা বাড়িতে নাস্তা করে না। তারা ইউনিয়ন-উপজেলার বাজারে চলে যায়। বিরাটসংখ্যক যুবক পড়াশোনার পাশাপাশি ‘সৌদি’ যাওয়ার জন্য দালালের পেছনে ঘুরে। সবার ধারণা, বিদেশ যেতে পারলেই জীবন হবে উন্নত। যারা বিদেশে থাকে, তাদের অনেকের উপজেলা শহরের বাড়িঘর ঢাকার বাড়িঘরের মতো। ঢাকার বড় বড় সাহেবদের গ্রামে এখন বাগানবাড়ি। এসব কি ৫০ বছর আগে ছিল? নিশ্চয়ই না। গ্রামাঞ্চল ছিল নীরব-শান্ত গাছপালাঘেরা মানুষের বসতিস্থল। পাশে ছিল নদী। পাল তোলা নৌকা, মাঠে গরু-ছাগল-এ দৃশ্য ছিল সেদিনকার। আজকে তা আর নেই। অনেক ক্ষেত্রে নদী নেই। গরু আর মাঠে নেই। গরুর জন্য হয়েছে খামার। মাছ, মুরগি চাষের জন্য হয়েছে নতুন নতুন খামার। জেলেরা হয়েছে দিনমজুর। তারা খামারে কাজ করে। কামার, কুমার, তাঁতির জীবন বদলে গেছে। চীনা দ্রব্যাদিতে বাজার সয়লাব। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কামার, কুমার এবং তাঁতি। সস্তা কাপড়ের কারণে দেশের বস্ত্রকলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত।
গ্রামের পাশাপাশি গত ৫০ বছরে শহরগুলোও আধুনিক রূপ ধারণ করেছে। ৬-৭ লাখ লোকের ঢাকা শহর এখন দুই কোটি লোকের শহর। ১৯৭২-৭৩ সালেও পুরান ঢাকায় টিনের বাড়ি ছিল। আজ এসব নেই। ১০ তলা, ২০ তলা ইমারতে ভর্তি ঢাকা শহর। স্কুল-কলেজের অভাব নেই। বেসরকারি স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার সংখ্যায় এখন প্রচুর। ৫০ বছর আগে এসব ছিল সরকারি। হাজার হাজার পেশাজীবী এখন ঢাকা শহরে। সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি হচ্ছে ব্যাংক-ম্যানেজার। উকিল, ডাক্তার, ব্যাংকার, অ্যাকাউনটেন্ট, আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে বিচিত্র পেশার লোক এখন ঢাকাতে। ৫০ বছর আগে তা ছিল না। ঢাকা শহরের আশপাশ অঞ্চল যথা-আশুলিয়া, টঙ্গী-জয়দেবপুর, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চল এখন তৈরি পোশাক কারখানায় ছড়াছড়ি। ৩০-৪০ লাখ শ্রমিক এসবে কাজ করে। তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো।
ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ চমৎকার। সারা দেশে যত ব্যাংক আমানত, তার ৪০ শতাংশই ঢাকা শহরে। বিপরীতে ঋণের ক্ষেত্রেও তাই। বিরাট পরিমাণের ব্যাংক ঋণ ঢাকা শহরের ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। শহরের পরিধি এখন উত্তরে নরসিংদী, জয়দেবপুর, পশ্চিমে সাভার-মানিকগঞ্জ, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ। ছোট মিউনিসিপ্যালিটির ঢাকা শহর এখন বিশাল করপোরেশন-দুই ভাগে বিভক্ত। জনসংখ্যার নিরিখেও ঢাকার পরিবর্তন আছে। ঢাকা শহরে আগে উত্তরবঙ্গের কোনো লোক ছিল না। এখন রংপুরের অনেক শ্রমজীবী মানুষের দেখা পাওয়া যায় ঢাকায়।
গত ৫০ বছরে আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। আগে কৃষির অবদান ছিল ‘জিডিপিতে’ সবচেয়ে বেশি। এখন সেবাখাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। শিল্প, ছোট শিল্পের অবদান ক্রমবর্ধিষ্ণু। আগে আমাদের রপ্তানিযোগ্য দ্রব্য ছিল পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা এবং চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য। এসবের রপ্তানিমূল্য এখন খুবই কম। এখন এসবের বিপরীতে স্থান পেয়েছে তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ। জনশক্তি রপ্তানি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক অর্থনীতির। আমরা এখন নিজের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে। এখন বৈদেশিক সাহায্য কম। ঋণের পরিমাণ বেশি, যা পরিশোধ করতে হবে। পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃব্যবস্থার কাঠামো তৈরি হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গেছে। এসব কাঠামোগত পরিবর্তন আমাদের অর্জন।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে আগামী ২৬ মার্চ। ২০২১ সাল। এ সময়ে খুবই বড় সংবাদ আমাদের জন্য-গত ২৬ তারিখে জাতিসংঘের ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি’ (সিডিপি) ‘এলডিসির’ তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ করেছে। কীসের ভিত্তিতে তারা বাংলাদেশকে উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে? ভিত্তিগুলো হচ্ছে-মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অসামান্য। ধীরে ধীরে আমরা এ অর্জনের জন্য কাজ করেছি। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার, যা এখন ২০৭৯ ডলার। ওই সময়ে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে বাজেটের পরিমাণ হচ্ছে ৫ লাখ এক হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পরিমাণ এ পঞ্চাশ বছরে মাত্র ৫০১ কোটি টাকা থেকে এক লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে তা মাত্র ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। যে পাকিস্তান আমাদের বিদ্রুপ করে বলত-স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? সেই পাকিস্তান ১৫০ পাকিস্তানি রুপি দিয়ে এক ডলার ক্রয় করে। আমরা ৮৫ টাকা দিয়ে তা ক্রয় করি। এতেই প্রমাণিত হয়, আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি। স্বাধীনতার পরপর ভারতীয় ৩০-৪০ রুপি ক্রয় করতে আমাদের লাগত ১০০ টাকা। আজ আমাদের ১০০ টাকা দিয়ে ভারতীয় রুপি পাওয়া যায় ৮০-৮৫।
অর্থনৈতিক-সামাজিক এ বিশাল পরিবর্তনের পাশাপাশি কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, আঞ্চলিক ও ব্যক্তিগত আয়-বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। দেশের একশ্রেণির নাগরিক বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবল আগ্রহ দেখাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশ হয়ে উঠছে বাঙালিদের একাংশের বসতিস্থল। এদের অনেকেই দেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে এখন সমাজ ও রাষ্ট্রনেতাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। দেশের উন্নতি হচ্ছে আর প্রভাবশালী লোকজন, বিত্তবান লোকজন, শিক্ষিত লোকজন দেশত্যাগ করছে-এ দুটো ঘটনা কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post