ড. মু. আলী আসগর
দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদানের সুযোগ না থাকায়, বর্তমান কোভিড-১৯ রোগ সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পূর্বের সেশনজটের অতিরিক্ত প্রায় ১ বছর সেশন জট সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করে। এদের বড় একটি সংখ্যা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার অনেক। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেই সংকট আরো তীব্রতর হয়েছে। যারা বেকার আছে, তাদের চাকরির খুব প্রয়োজন। তাদের জীবনটা এই মহামারির কারণে একটা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবেলার অংশ হিসেবে গত বছর মার্চের ১৭ তারিখ থেকে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়ার একটি পরিকল্পনা করেছে সরকার।
তিনি বলেন, “এখন তো ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা টিকা নিচ্ছেন। এরপরের ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে যে শিক্ষার্থীরা থাকেন, তাদেরও টিকা দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।” স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ৩ মার্চ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, দেশের সকল শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে আশির দশকে (১৯৮০ থেকে ১৯৯০) মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৮ বছর এবং নব্বই-এর দশকে (১৯৯০ থেকে ২০০০) মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৫ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ দশমিক ৬ বছরে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালের হিসাবে এ আয়ুষ্কালের তথ্য উঠে এসেছে। বিবিএসের ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৯’ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) তৃতীয় পর্যায় প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের দুই হাজার ১২টি নমুনা এলাকার দুই লাখ ৯৮ হাজার ৮১০টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই তথ্য দিয়েছে বিবিএস।
১৯৮০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ স্নাতক, বিশেষত স্নাতকোত্তর শিক্ষা ২৭ বছর বয়সের মধ্যে শেষ করতে পারছিল না। বিষয়টি অনুধাবন করে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ১৩ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়। নব্বইয়ের দশকে (১৯৯০ থেকে ২০০০) দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৫ বছর। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর। ফলে এখন মানুষের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কত হবে? বর্তমান ৩০ বছর থেকে এ বয়স অন্তত দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করা তো খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তবে মেধাবী চাকরিপ্রার্থীকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এ বয়স ৩৫ বছর করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করলে দেশ উপকৃত হবে বলে আশা করি। কারণ যারা একাডেমিক ভালো রেজাল্ট করে, তারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াকালীন সময়ে বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি/আধা-সরকারির চাকরীর জন্য প্রস্তুতি নেয় না। তারা মূলত স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির প্রস্তুতি নেয়। দেশে পর্যাপ্ত একাডেমিক জব না থাকায় এবং সরকারি চাকরিতে যে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তার কারণে অনেক মেধাবীর স্বপ্ন-ইচ্ছা-প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বয়সের কারণে কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার হরিণ’ ধরা সম্ভব হয় না।
দেশে যেভাবে দিন দিন সরকারি চাকরি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, যেভাবে মেধাবীরা এদিকে ঝুঁকছেন, তা ইতিবাচক। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর বেশি। স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তারের চেয়ে নার্স বেশি থাকার কথা – বিষয়টিকে বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৬ করেছেন।
করোনা দুর্যোগের মধ্যে চাকরিপ্রত্যাশীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বয়সে ছাড়ের সরকারি সিদ্ধান্ত শুধু যৌক্তিকই নয়; প্রশংসনীয় ও আশারও বটে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম/২য়/৩য় বর্ষে যারা অধ্যয়নরত রয়েছে, তারা সঙ্কটের কারণে সেশন জটের ফলে বয়স ছাড়ের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। সে কারণে, একই সঙ্গে সরকার ইতোমধ্যে বয়স ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে যে সদিচ্ছা প্রদর্শন করেছে, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা যৌক্তিক ও স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করলে মেধাবী চাকরিপ্রার্থী যুবসম্প্রদায় তথা দেশের জন্য কল্যাণকর হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post