ড. রওনক জাহান
দুই মহান উপলক্ষ—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী—আমাদের বাংলাদেশ সৃষ্টির মুহূর্ত এবং সেই সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অনন্য ভূমিকার কথা আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমরা যারা বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে আবির্ভূত হতে দেখেছি এবং তার পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে অসামান্য অবদান তা প্রত্যক্ষ করেছি, তাদের পক্ষে তাঁর কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূল্যায়ন ভাষায় ব্যক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। আজকের এই রচনায় আমি আলোচনা করব কীভাবে শান্তি, মুক্তি ও মানবতা—এই তিনটি বিষয় বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড, চিন্তাধারা এবং পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও চিন্তাধারায় মানবতা, মুক্তি ও শান্তি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রথমেই তাঁর একটি উদ্ধৃতি রয়েছে যাতে তিনি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন প্রথমে মানুষ এবং তারপর বাঙালি হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙ্গালী হিসাবে যা কিছু বাঙ্গালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা।’
দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর আকাঙ্ক্ষা খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ করি। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি এবং সমাজসেবার কাজে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দরিদ্র, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু বাঙালির বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, বারবার কারাবরণ করেন। তবে সে সময় বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার পাশাপাশি তাঁর বৃহত্তর সংগ্রাম ছিল বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন শোষণের হাত থেকে মুক্ত করা এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের ধ্যানধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সুষম সমাজব্যবস্থার চিন্তা। তিনি বলতেন, তিনি কমিউনিস্ট নন, কিন্তু তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি চান নির্যাতিত মানুষের শোষণমুক্তি এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যের দূরীকরণ।
তরুণ বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষের সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ১৯৫২ সালে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি চীন সফর করেন, যেখানে বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী এবং মানব মুক্তিকামী সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। আমার দেখা নয়া চীন বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তিনি সারা জীবন ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্মের নামে সহিংসতা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে যে তিনি সব সম্প্রদায়ের সহ-অবস্থানের কথা বলেছেন শুধু তা-ই নয়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার যে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে, সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি সারা জীবন কাজ করেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণেও তিনি জনগণকে সতর্ক করেন যাতে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা না ঘটে। তিনি বলেন, ‘দেখবেন, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বৎসরে তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমাগত বেগবান হয়েছে, কিন্তু তিনি সব সময়ই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুন্দরভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে একই সঙ্গে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। সারা বিশ্বে তাঁকে তুলনা করা হতো মহাত্মা গান্ধী কিংবা মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে, যাঁরা অহিংস আন্দোলন করেছিলেন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। শান্তি, মুক্তি এবং মানবতার অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিতে মানবতা, মুক্তি ও শান্তি
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রভাবেই গঠিত হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, যার মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বশান্তি ও আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ‘সবার সঙ্গে মৈত্রী এবং কারও সঙ্গেই বৈরিতা নয়’—এই ছিল তাঁর পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি। তিনি বলতেন, বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হিসেবে তিনি গড়ে তুলতে চান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদর্শ ছিল জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। সমগ্র পৃথিবীর, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতি বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ আরবদের সমর্থনে মেডিকেল ইউনিট এবং চা পাঠিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত এই মানবতার পথ ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ২০১৭ সালে সাত লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় দিয়ে নিজেকে সারা পৃথিবীতে মানবতার অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতিসংঘ যে মানবিক অগ্রগতির লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে, তারও তিনি প্রশংসা করেন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পাশাপাশি তিনি স্বনির্ভরতার ওপরও জোর দেন।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বক্তৃতা শেষ করেন ‘মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস এবং মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতার’ ওপর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। তিনি বলেন, ‘আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি…জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’
[বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে ২৪ মার্চ ২০২১ পঠিত বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত ভাষ্য]
ড. রওনক জাহান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সম্মানিত ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
Discussion about this post