ড. একরামূল ইসলাম
ভারতে করোনা রোগীদের শরীরে ঘটছে এক ধরনের ছত্রাকের সংক্রমণ, যার নাম ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’। করোনার দোসর হয়েছে এ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ রোগকে ‘মিউকরমাইকোসিস’ বলা হয়। এটি এক ধরনের বিরল তবে মারাত্মক ছত্রাক সংক্রমণ, যা মিউকরমাইসেট নামে এক ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে। কিন্তু এটি সংক্রামক নয় এবং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে না।
সাধারণত মানুষ নিজের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে এর মোকাবিলা করতে পারে সহজেই। কিন্তু করোনা সংক্রমণের চিকিৎসায় রোগীকে এমন কিছু ওষুধ দেওয়া হয়, যাতে তার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে এই ফাংগাল সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তবে এটি শুধু যে করোনা রোগীদের মধ্যেই ছড়ায় এমন নয়। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, আগে কোনো গুরুতর রোগের ইতিহাস আছে বা যারা ডায়বেটিস আক্রান্ত, অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট করা ব্যক্তি, কেউ যদি স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে এ ছত্রাক যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ এবং সংক্রমণের মাত্রাও তাদের ক্ষেত্রে গুরুতর হতে পারে।
করোনা অতিমারি ছড়ানোর আগে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখা যেত প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে একজনের শরীরে এবং মৃত্যুর হারও যথেষ্ট বেশি। কোভিড রোগীদের কিংবা কোভিড থেকে সেরে ওঠা মানুষদের ক্ষেত্রেই এ সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে ভারতজুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এ অসুখও মহামারি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে।
চিকিৎসকরা ভারতের করোনা রোগীদের এ ফাঙ্গাস সংক্রমণের অনেক কারণ চিহ্নিত করেছেন- ১. গুরুতর অসুস্থ কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য জীবনরক্ষাকারী হাইডোজের স্টেরয়েড প্রয়োগ। স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে অনেক সময়ে ডায়াবেটিস ও নন-ডায়াবেটিস কোভিড-১৯ উভয় রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা এবং অ্যাসিডযুক্ত রক্ত এ ছত্রাকের বংশবিস্তারের জন্য একটি উর্বর পরিবেশ তৈরি করে। ২. ‘অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস’-ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১২ থেকে ১৮ শতাংশের ডায়াবেটিস রয়েছে, বিশেষত শহরাঞ্চলে এর হার আরও বেশি?
এমনকি অনেক রোগী কালো ছত্রাক নির্ণয় না করা পর্যন্ত তাদের যে ডায়াবেটিস রয়েছে তা জানতেন না। ৩. যেসব রোগীর দীর্ঘদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা হয়েছে, বা দীর্ঘদিন নলের মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হয়েছে, তাদের শরীরে এ ধরনের সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে এ অসুখ ছড়াচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের হিউমিডিফায়ার থেকেই। ৪. গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু যা ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত। ৫. কোন পরিবেশে রোগী রয়েছেন তার ওপর নির্ভর করছে। কারণ পরিবেশে, মাটিতে এটি আগে থেকেই ছিল।
মিউকরমাইকোসিস নামক মারাত্মক এ ছত্রাক সংক্রমণের ফলে রোগীরা কান, চোখ, চোয়ালের সমস্যায় ভুগছেন? শরীরের কোনো ক্ষত, কাটা জায়গা, পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থান দিয়ে শরীরে ঢোকে এ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। এ ছাড়া বাতাসে ভাসমান ফাঙ্গাসের স্পোরগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেও সাইনাস ও ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। সাইনাস, মস্তিষ্ক আর ফুসফুসে ছাড়া খাদ্যনালি, ত্বক এবং অন্যান্য অঙ্গেও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। এ রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথা, কাশি, রক্তাক্ত বমি, চোখ বা নাকের চারপাশে ব্যথা এবং লালভাব, নাকের উপরে কালো ছোপ, দেখতে অসুবিধা হওয়া। নাকের ভেতরের অংশ কালচে রঙের হয়ে যায়। মুখ, গালে ব্যথা। সংক্রমণ বেশি ছড়ালে বুকে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে। শেষে হয় মর্মান্তিক মৃত্যু!
মিউকরমাইকোসিসের সংক্রমণ এড়াতে করণীয় :
অনেক ধূলিকণা যেমন নির্মাণ বা খননকাজের জায়গা, যেখান থেকে ধুলাবালি ছড়িয়ে পড়ছে এমন জায়গা এড়িয়ে চলা? জুতার সঙ্গে মোজা ব্যবহার করা। খালি পায়ে না ঘোরা। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের স্পর্শে না যাওয়া।
বাড়ির আঙিনা বা বাগানের কাজে/মাটি খননের সময় জুতা, লম্বা প্যান্ট, লম্বা হাতা শার্ট ও গ্লাভস পরিধান করা। ত্বকে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা কমাতে পচা মাটি বা ধূলিকণার সংস্পর্শে গেলে সাবান ও পানির সাহায্যে ত্বক পরিষ্কার করা। ব্লাড-সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে অ্যান্টি ফাংগাল ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। ডায়াবেটিস ছাড়াও যেসব কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির ক্যান্সার, কিডনি রোগ কিংবা লিভার সমস্যা রয়েছে, তাদের সাবধান থাকতে হবে। শুধু করোনা চিকিৎসা চলার সময় নয়, সুস্থ হয়ে ওঠার পরও।
কারণ, করোনা থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পরও অনেকের নতুন করে দেখা দিচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ। এটি কোভিডের মতো সংক্রামক নয়, তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
ড. একরামূল ইসলাম : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশবিদ্যালয়
Discussion about this post