সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
উত্তরণ কখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ও পর্যাপ্ততায় সম্ভব হবে না, যদি না এটি জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষিত হয় এবং এ লক্ষ্যে কাজ এখনি শুরু হয়।
অগ্রাধিকার হতে হবে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সদিচ্ছা ও সংকল্পের ভিত্তিতে; অর্থাৎ রাষ্ট্র এ জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সমর্থন দেবে, সরকার এর বাস্তবায়ন করবে এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাতে সমর্থন করবে এবং শিক্ষায়তন ও সমাজ তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে।
পরিকল্পনায় থাকবে বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি এবং মহামারি চলতে থাকলে সম্ভাব্য ক্ষতি আরও কী হতে পারে তা নিরূপণ; আর্থিক বরাদ্দ কোথায় কতটা দিতে হবে তা নির্ধারণ; আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং বাস্তবায়নের পর্যায়ক্রমিক একটি ছক তৈরি করা। এ জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা- এই তিন ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে।
মহামারি থেকে মুক্তি মিললেও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরাসরি শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা আরও কিছুকাল চালিয়ে যেতে হবে। মানবিক বিষয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে দিতে হবে। সেজন্য ইতোমধ্যে যে ডিজিটাল বৈষম্য অর্থাৎ ৩০-৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী যে অনলাইন শিক্ষায় সম্পৃক্ত হতে পারেনি অথবা কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, তা নিরূপণ করা একান্ত জরুরি। এই শিক্ষার্থীদের একটি ডাটাবেজ বা নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে এবং কিছুটা সংগতিপূর্ণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের সহজ কিস্তিতে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ পৌঁছে দিতে হবে। একই সঙ্গে যারা ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে, তাদেরও এই পরিকল্পনায় নিয়ে আসতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের সন্তানদের বৃত্তি আরও বাড়াতে হবে। স্কুলগুলোতে একবেলা খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে যা আছে তা আরও জোরদার করতে হবে। স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী যারা পড়াশোনার অনুপস্থিতিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে অথবা পিছিয়ে পড়েছে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য ছুটির দিনে স্কুলে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী টিউশনি করে কিছু উপার্জন করত, সারাদেশে তাদের ভালো সম্মানী দিয়ে এই কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে।
শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। যদি তা নিয়মের বেড়াজালে আটকে যায় তাহলে তাদের যথেষ্ট আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।
প্রকোপ একটু কমলে শিক্ষায়তনগুলো জীবাণুমুক্ত করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিতে হবে। এ জন্য একটি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের তিনটি কেন্দ্রে বসার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হবে। এজন্য সব শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা একসঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সিলেবাস একটু কমিয়ে পরীক্ষা গ্রহণের সময় কমিয়ে প্রয়োজনে অন্য বোর্ডের স্কুল-কলেজ থেকে পরিদর্শক হিসেবে শিক্ষকদের এনে পরীক্ষাগুলো নেওয়া যায়।
তবে জাতীয় অগ্রাধিকার থেকে ডিজিটাল বৈষম্য নিরসন এবং অতিরিক্ত সব খরচের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দের পক্ষে সরকারের সদিচ্ছার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সরকারকে বুঝতে হবে এর বিকল্প হচ্ছে একটা বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলা। তাকে উন্নয়নের গতি বা সুফল কিছুই আর নিশ্চিত করা যাবে না। প্রয়োজনে দু’একটা মেগা প্রকল্প স্থগিত রেখে শিক্ষার এই মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
লেখক : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ
Discussion about this post