প্রফেসর ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিজিটাল আসক্তি নামে পরিচিত। ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরণ রয়েছে, যথা ফোন আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি। সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা এ আসক্তিতে বেশি আক্রান্ত। ডিজিটাল আসক্তিতে কিভাবে আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা আক্রান্ত হয়ে থাকে এ নিয়ে ইতিপূর্বে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো, পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি বা ১০০ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৯৩.৭০২ মিলিয়ন যা মোট জনসংখ্যার ৬২%। করোনাকালে, এ সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সি অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের কল্পনাশক্তি এবং চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক ইন্ডাস্ট্রি হলো পর্নো ইন্ডাস্ট্রি। বলা হয়, পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে একটি মাল্টি-ট্রিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি! এমনকি সার্চ ইঞ্জিনসহ বড় বড় জনপ্রিয় সাইটই পর্নো ইন্ডাস্ট্রিকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে। ইন্টারনেটে ইনডেক্স করা প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন পর্নোগ্রাফিক সাইট আছে, যেখানে সহজেই যে কেউ যখন তখন প্রবেশ করতে পারে। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কারণে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ৫-৭ বছরের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিশুর ১২ শতাংশ এবং ৮-১৭ বছরের ১৬ শতাংশ শিশুর সামনে ইনডেক্স করা এই ৪৫০ মিলিয়ন পেজের সাজেশন্স চলে আসে; শিশুমন পরিচিত হয় পর্নোগ্রাফি নামক এক দানবের সঙ্গে।
সম্প্রতি আমেরিকার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কিশোরীদের ৯০% এরও বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এবং ভিডিও গেম খেলেন। ৫০% কিশোররা স্বীকার করে যে তারা তাদের স্মার্টফোনে আসক্ত বোধ করে। গত বছরের এই সময় থেকে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত ৩২১ মিলিয়ন নতুন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী বেড়ে ৩.৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। ৫.১৯ বিলিয়ন মানুষের (বিশ্বের জনসংখ্যার ৬৭%) কমপক্ষে একটি মোবাইল ফোন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারী পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান; ৯১% মহিলা এবং ৯০% পুরুষ।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখে যাচ্ছে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ফেস–টু–ফেস ইন্টার–অ্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস তাঁর সন্তানদের নিজের প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। তিনি একবার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের যে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’
ডিজিটাল আসক্তিতে শিশু কিশোর শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধ প্রবণতা, উদ্বেগ, একাকিত্ব থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধাত্ব, নিয়মিত স্কুলে যেতে ইচ্ছা না করা, ভালো কথার নেগেটিভ রিয়্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উম্মাদননা ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতাদেখা দেয় এমনকি এক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পেরে আত্মহত্যার মত ঝুকিও নিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন অনেকগুলো দুর্ঘটনাও ঘটেছে।
অনুরুপভাবে শারীরিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে তাদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, পিঠে ব্যাথা, ঘাড় ব্যথা, কার্পাল টানেল সিনড্রোম, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, অস্বাস্থ্যকর পুষ্টি, দুর্বলতা, কার্পাল টানেল সিনড্রোম, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, চোখের শুষ্কতা, অন্যান্য দৃষ্টি সমস্যা, অতিরিক্ত ওজন হ্রাস বা স্থূলত্বসহ বিভিন্ন ধরণের রোগ শরীরে দানা বাঁধতে থাকে।
এই মানসিক এবং শারীরিক প্রভাবগুলির পাশাপাশি, ইন্টারনেট আসক্তিতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ক্ষতিও হয়ে থাকে। ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে ওঠে, কারোর সাথে মিশতে চায় না, যোগাযোগ রাখতে চায় না, আত্মীয় বা বন্ধুদের সাথেও ঠিকমত কথা বলতে চায় না ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। মোটকথা, ডিজিটাল আসক্তি শিক্ষার্থীদের জীবনে মারাত্বক ক্ষতি সাধন করে থাকে। লেখাপড়া ঠিকমত না করে অনেক ক্ষেত্রে বখাটেপনা জীবন যাপন করে এবং পরিণত হয় এক ভয়ংকর কিশোর গ্যাঙে। তখন সমাজে অনাচার, অত্যাচার, নিরাপত্তাহীতার পরিবেশ তৈরি। ফলে পিতা মাতার কাছে আদরের সন্তানেরা তখন বোঝার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে ইন্টারনেটের আসক্তি কীভাবে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদেরকে প্রভাবিত করছে। ইন্টারনেটের আসক্তিকে কীভাবে বীট দিয়ে এটি থেকে দূরে থাকা যায়, সে সম্পর্কে নিম্নের কিছু কার্যকর টিপস/পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারেঃ
১। মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় পর্যাপ্ত অপ্রাসংগিক নোটিফিকেশন বা বিজ্ঞাপন ভেসে ওঠে, যা শিশু-কিশোরদেরকে অনলাইনে যাওয়ার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। এ বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে পারলে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সহযোগিতা করবে।
২। অভিভাবক বা শিক্ষকদেরকে মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মা বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যা করতে দেখে তাই অনুকরণ করে থাকে। তাই অভিভাবকদেরকে অনলাইন ব্যবহারের অভ্যাস পর্যালোচনা করে নেতিবাচক আচরণ বর্জন করতে হবে। তাহলে সন্তানদের ইন্টারনেটের আসক্তি থেকে মুক্ত রাখা সহজ হবে।
৩। অন্যের সাথে তথা আত্বীয় স্বজনদের সাথে সন্তানদের সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে হবে এবং তাদের সাথে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করতে হবে। ইন্টারনেটে বেশী সময় ও শক্তি ব্যয় করলে অন্যের সাথে সুসম্পর্ক নষ্ট হয় এবং ডিজিটাল আসক্তি বৃদ্ধি পায়। সুতরাং কাছের মানুষদের সাথে উপযুক্ত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে সন্তানদেরকে এ জাতীয় আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে।
৪। সংযত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তি উভয়ই ছেলেমেয়েদেরকে কম্পিউটারে শপিং করা, গেম খেলা বা লগ ইন করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে, যা ডিজিটাল আসক্তি তৈরির অন্যতম কারণ। সুতরাং ডিভাইস ব্যবহারে নিজেদেরকে যেমন সংযত থাকতে হবে, তেমনি সন্তানদেরকেও সময় নির্ধারণ করে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে, ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল আসক্তি কমে যাবে।
৫। বাসা-বাড়িতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রযুক্তিগত ডিভাইস ও মোবাইল থাকা এবং সেগুলি যত্রতত্র রাখা ঠিক নয়। কারন ঘুরতে ফিরতে ছেলেমেয়েরা তা স্পর্শ করতে আগ্রহি হয় এবং ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং বাসাতে ডিভাইসগুলির জন্য নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ রাখা উচিৎ এবং সেগুলিকে অন্য জায়গায় ব্যবহার করতে নিষেধ করতে হবে। শয়নকক্ষ, স্টাডি রুম এবং ডাইনিং অঞ্চলগুলি অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
৬। অভিভাবকদের ব্যবহার্য ডিভাইসের স্ক্রিনের সময়টি ট্র্যাক করা ডিজিটাল আসক্তি রোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে যা সময় ট্র্যাক করতে এবং প্রযুক্তির আসক্তি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও প্যারেন্টিং অ্যাপস রয়েছে যা ছেলেমেয়েদের ডিভাইসে সময় ট্রাকিং সেট করতে এবং আসক্তি রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৭। ডিজিটাল ডিটক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মাঝে মাঝে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সবচেয়ে ভাল উপায়। ডিজিটাল ডিটক্স এবং পুনরায় সংযোগ কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে এটিতে দশটি সহজ পদক্ষেপ রয়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক ও ছেলেমেয়েরা এ পদক্ষেপগুলি প্রয়োগ করতে পারেন। ডিজিটাল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল আসক্তি থেকে রক্ষা পেতে পারে।
৮। মোবাইলের স্ক্রিনের ডিজাইন বার বার পরিবর্তন না করা উচিৎ। স্ক্রিনের বর্ণিল নানা ধরণের ডিজাইন ছেলেমেয়েদেরকে মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত করে তোলে। সুতরাং মোবাইল স্ক্রিন সেটিংস এর ক্ষেত্রে সর্বদা স্বাভাবিক ডিসপ্লে ব্যবহার করা আবশ্যক।
৯। ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। যখন তখন অভিভাবক বা শিক্ষকদের খেয়াল খুশিমতো ইন্টারনেট ব্যবহার করা ঠিক নয়। সময়ে অসময়ে অভিভাবকদের ইন্টারনেটে ব্যবহার করতে দেখলে, ছেলেমেয়েরাও আস্তে আস্তে ডিজিটাল এপ্লিকেশনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। কথোপকথনের সময় বা রেস্টরুমে যাওয়ার সময় কিংবা খাওয়ার সময় কোনভাবেই মোবাইল ব্যবহার করা উচিৎ নয়। ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সময়ের চাকাগুলি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমেরিকান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সে দেশের অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছে, ছেলেমেয়েদের ‘স্ক্রিন টাইম লিমিট’ বেঁধে দিতে হবে।
১০। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এটিকে পজিটিভলি ব্যবহার করতে পারলে ডিজিটাল আসক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা অনলাইন কার্ক্রমের ফাঁকে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে তারা লিপ্ত হয়ে যায়। এজন্য ‘মেন্টাল আপে’র মতো উপকারী এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশনগুলি ডাউনলোড করে রাখা উচিৎ, যা ছেলেমেয়েদেরকে শুধু বিনোদনই দেয় না, বরং মানসিক দক্ষতা এবং অন্যান্য অনেক জ্ঞানীয় দক্ষতাও উন্নত করে।
১১। শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদেরকে পর্যাপ্ত বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। বই পড়লে মনের বিকাশ লাভ হয়, বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়, জ্ঞানের গভীরতা তৈরি হয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে, ডিজিটাল আসক্তি থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে থাকতে পারে। আমেরিকার সিনসিনাটি চিলড্রেনস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকেরা সম্প্রতি ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) প্রযুক্তির সাহায্যে শিশুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা লক্ষ করেছেন, শিশুরা যখন কিছু পড়ে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ (ফাংশনাল ব্রেইন কানেকটিভিটি) বেড়ে যায়। আর যখন ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় অডিও–ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট দেখে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ কমে যায়। তাই গবেষকদের পরামর্শ হলো, শিশুদের মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশের জন্য পড়ার সময় বাড়াতে হবে, স্ক্রিনে চোখ রাখার সময় কমিয়ে আনতে হবে।
১২। একটি সুস্থ শরীর মানে একটি সুস্থ মন। শারীরিক অনুশীলন ছেলেমেয়েদেরকে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয় এবং মনোজাগতিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এজন্য তাদেরকে আউটডোর একটিভিটিতে শরীর চর্চার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে এবং উম্মুক্ত মাঠে তাদের নিয়মিত যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টারনেটের আসক্তি রোধ করতে সহায়তা করবে।
অতএব, এটা আজ আর অত্যুক্তি নয় যে, ডিজিটাল আসক্তি ড্রাগ আসক্তির মত একটি ভয়ংকর ব্যাধি, যা থেকে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদেরকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ডিজিটাল আসক্তিকে অনেকে ডিজিটাল ড্রাগ বলেও এখন ব্যাখ্যা করছেন। এ আসক্তি এতটাই ভয়াবহ যে স্বয়ং মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করতে দেননি। ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার ফেসবুক ছেড়ে দেওয়ার পরে ফেসবুক সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই যে ক্ষণিক, ডোপামিন তাড়িত ফিডব্যাক লুপস আমরা তৈরি করেছি, এটা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক সক্রিয়তা নষ্ট করে দিচ্ছে। সামাজিক আলাপ-আলোচনা নেই, পারস্পরিক সহযোগিতা নেই; আছে ভুল তথ্য আর মিথ্যা।’
ফেসবুকের সাবেক এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট আথেনা শাভারিয়া বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমাদের ফোনের মধ্যে বাস করে শয়তান, সে ছেলেমেয়েদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে।’ তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট বয়সের আগে ফোন ব্যবহার করতে দেননি। এখনো বাড়িতে তাদের ফোন ব্যবহারের সময়সীমা কঠোরভাবে বেঁধে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, কোনো ক্লাসের সেই ছেলেটি বা মেয়েটিই সবচেয়ে ভালো করবে, যার হাতে ফোন পৌঁছাবে সবার পরে।
ডিজিটাল প্রযুক্তিবিদ, কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ নিজেদের তৈরি করা ডিজিটাল যন্ত্র ও অ্যাপ থেকে সন্তানদের দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। আমেরিকার ‘সিলিকন ভ্যালি’র প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে এ রকম একটা সাধারণ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে শিশু-কিশোরদের শেখার বা জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল যন্ত্রের ভূমিকার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে এসব যন্ত্রের প্রতি তাদের আসক্তির ঝুঁকি। এই আসক্তির ক্ষতিকর ফলাফল ধরা পড়ছে মনোবিজ্ঞানী ও ব্যবহারবিজ্ঞানীদের গবেষণায়; শিশু–কিশোরদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, তাদের আচরণে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তিবিদদের ৯০০’র বেশি পরিবার ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল আসক্তি কমানোর সংগ্রামে নেমেছে। শিশুদের সব ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন পরিবারের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই পরিবারগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নো টেক হোমস’। এমনকি ওসব পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার জন্য ন্যানিদেরও চুক্তি করতে হচ্ছে যে তাঁরা যতক্ষণ ওই বাসায় থাকবেন, ততক্ষণ ফোন ব্যবহার করবেন না।
তাই, আসুন আমরা যেভাবে মাদকাসক্তিকে সামাজিকভাবে বর্জন করে ‘মাদককে না বলো’ স্লোগান আবিস্কার করেছি, ঠিক সেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে নয় বরং এটিকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রেখে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি, দূর হোক আসক্তি’ এ স্লোগানে উদবুদ্ধ করি এবং ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত আদর্শ সমাজ গঠনে ব্রতি হই। আমি বিশ্বাস করি, উপরে বর্ণিত টিপ্স/পদক্ষেপগুলি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদেরকে ডিজিটাল আসক্তিমুক্ত করে বাংলাদেশে একটি উন্নত জাতি গঠন করা সহজ ও সম্ভব হবে।
প্রফেসর ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
লেখক, গবেষক ও প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
Discussion about this post