অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন
আগস্ট মাসের মতো দুঃখের মাস বাঙালির ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, এই মাসেই বাঙালি হারিয়েছে তার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির রাখাল রাজা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক বীরের জাতির পরিচয় ঘটে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে৷
ভারত বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ শ্রী চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে’।
যে মানুষের স্বাধীনতার জন্য, স্বাধিকার আদায়ের জন্য তিনি যৌবনের স্বর্ণকাল জেলেই কাটিয়েছেন, সেই বাঙালির হাতেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে গিয়েছে, এমনটি ভাবা যতটা কষ্টের, মেনে নেয়া আরও বেশি কষ্টের। তবে জাতির পিতার ইতিহাস তো এত সহজে মুছে ফেলার মত নয়। কিছু মহানায়কের জন্মই হয় এমনভাবে যে মৃত্যু তাঁদের ছুঁতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু তেমনই একজন মহানায়ক। মহানায়কদের মহানায়ক। যিনি অমর, যার মৃত্যু নেই। ঘাতকরা ভেবেছিলো বুলেট দিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলা যায়, আসলে তারা নির্বোধ।
কবিগুরুর কবিতা তাদের কানে হয়তো পৌঁছায়নি-
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই, ওরে ভয় নাই,
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই-তার ক্ষয় নাই”।
দ্য টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়, সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। একইদিনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
জাতির পিতা তাঁর জীবনের ব্যাক্তিগত সুখ-শান্তি ভুলে জাতীয় স্বার্থে অকাতরে সময় ব্যয় করেছেন। দেশকে শোষকদের নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে মুক্ত করতেই রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, অদম্য স্পৃহা, সীমাহীন ত্যাগ, দৃঢ় প্রত্যয়, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সম্মোহনী বাগ্মিতা, ও আদর্শের দ্বারা বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন।
স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত আত্মত্যাগে বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্মলাভ, ’৪৮-এর মার্চে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন করে তাঁর কারাজীবনের সূচনা করেন, ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম, ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালে ম্যাগনাকার্টা খ্যাত বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা ঘোষণা, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১১-দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ’-এর নিরঙ্কুশ বিজয়সহ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
‘৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মানসিকভাবে সর্বোচ্চ প্রস্তুত করে তোলে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য যার যা কিছু আছে তা নিয়েই সকলকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হলো সশস্ত্র সংগ্রাম। রক্তের মহাসাগর, ৩০ লক্ষ শহীদের লাশের পাহাড় ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো। জাতির পিতা হিসেবে মর্যাদা পেলেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার খুব বেশি সময় তিনি পাননি। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ঘাতকরা তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও জাতির পিতার ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন।
দেশের বাইরে থাকায় সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কিন্তু ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে বারবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর হামলা করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুঁড়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেদিনও শেখ হাসিনা বেঁচে যান, তবে এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী, আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেই কুচক্রী মহল ক্ষান্ত হয়নি তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য বন্ধ করতে ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক ইনডেমনিটি আইনও জারি করেছিল। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্যদিয়ে তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করতে, বাংলাদেশকে একটি ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ দুই দশক বাঙালি জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ককের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বমঞ্চে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। ঘাতকের স্বপ্ন হয়েছে ধূলিসাৎ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন হয়েছে অমর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়- শত্রুর মুখে ছাঁই দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে দীর্ঘ ২১ বছরের বিচারহীনতার কলঙ্ক মুছতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাও বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে থাকেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল, মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। জাতির পিতাকে হত্যা করলেই তাঁর স্বপ্ন মরে যায় না। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার পুরোটাই বাস্তবে রূপ নেবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা করোনার এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠবো, দেশ পর্যায়ক্রমে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে, এবং অচিরেই উন্নত দেশের তালিকায় নিজের দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে।
বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করার বুলি দেয়া আর সেই চেতনা ধারণ করে কাজ করে যাওয়ার মাঝে অনেক তফাত। ব্যক্তিস্বার্থে বঙ্গবন্ধুর চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা ব্যবহারের অপসংস্কৃতি দ্রুত বন্ধ না হলে এ জাতি দ্বিতীয়বারের মতো নিজেদের আত্মঘাতী সত্ত্বার প্রকাশ ঘটাবে। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারলেই সততার সাথে মানবসেবার ব্রত পালনে আর কোন বাঁধা কাজ করতে পারেনা। প্রজন্মান্তরে এভাবেই বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু। কারণ, মহানায়কের দেহের মৃত্যু হলেও তাঁর কর্মের কোন মৃত্যু হয় না-
“কে বলেরে মুজিব নাই,
মুজিব সারা বাংলায়।”
লেখক: প্রাধ্যক্ষ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কোষাধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
Discussion about this post