সামসুল আলম সজ্জন
১৭ সেপ্টেম্বর, মহান শিক্ষা দিবস। আজ থেকে ৫৯ বছর আগে ১৯৬২ সালে পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছাত্র আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন শিক্ষা দিবস। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের দমনপীড়নের বিপরীতে তৎকালীন ছাত্রসমাজের প্রতিরোধ যুদ্ধের এক গৌরবগাথা।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে। ছাত্রনেতাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘স্বৈরতান্ত্রিক আইয়ুবশাহী…ছাত্র বেতন বৃদ্ধি করিয়া, তিন বৎসরের ডিগ্রি কোর্স চালু করিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কৃষি ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আসন সংখ্যা কমাইয়া দিয়া, স্কুল কলেজে বইয়ের বোঝা বৃদ্ধি করিয়া, তোগলকী সিলেবাস চালু করিয়া বৎসর বৎসর অর্থ ব্যয়কারী ফাইনাল পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করিয়া আসলে এমন এক শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করিয়াছে যাহাতে অধিকাংশ জনসাধারণের পুত্রকন্যাগণের শিক্ষা গ্রহণের পথই রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে।’
ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ ডাকসু, বিভিন্ন হল ও কলেজ ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সাধারণ ছাত্রদের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৫ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অব্যাহতভাবে ধর্মঘট চলতে থাকে। ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
১০ সেপ্টেম্বর সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে প্রতিবাদস্বরূপ ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ওইদিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সমাবেশ শেষে কার্জন হল থেকে বিক্ষুব্ধ মিছিল বের হয়। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় ব্যবসায়ী, কর্মচারী, রিকশা শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এমন সংবাদ পেয়ে মিছিল নবাবপুরের দিকে যাত্রা করলে হাইকোর্টের সামনে পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ঘটনাস্থলে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহ পরদিন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। যশোর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে পুলিশের নির্যাতনে বহু ছাত্র আহত ও গ্রেপ্তার হন। টঙ্গীতে গুলিতে নিহত হন শ্রমিক সুন্দর আলী।
ছাত্র অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনে আইয়ুব খান সরকার শরীফ কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত এবং তৃতীয় বর্ষের স্নাতক পরীক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান করার ঘোষণা দেয়। এ আন্দোলনের ফলে সামরিক আইনে অধ্যাদেশ জারি করে নিবর্তনমূলক কায়দায় রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরির বিপরীতে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ব্যাপক গণজাগরণ তৈরি হয়।
প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বাস্তবতায় জনসংখ্যা বিবেচনায় একটি দেশে প্রাথমিক (আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক), মাধ্যমিক, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, কৃষি ও পশুপালন মহাবিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় সংখ্যা যথাযথভাবে নিরূপণ করা জরুরি। শিক্ষার্থীর আসন বিন্যাস, প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকের চাহিদা, অবকাঠোমো নির্মাণসহ ভৌত সুবিধার প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত শিক্ষাক্ষেত্রে এই সময়ের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ইতোপূর্বে অর্জিত জ্ঞানের কতটা শিক্ষার্থীরা মনে রাখতে পেরেছে সেটা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তাদের সামনের দিকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
সরকারের অবশ্যকরণীয় হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সচল করা। মহামারিকালে অন্তর্বর্তীকালীন বিশেষ শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
১৭ সেপ্টেম্বর পালন কেবল শিক্ষা ভবনের কাছে হাইকোর্টের সামনে শিক্ষা অধিকার চত্বরে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, আলোচনা সভা, মিছিলসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা দিবস পালন করার পাশাপশি শিক্ষার অধিকার আদায়ে সচেতন হতে পারতো। তাই এদিনটি জাতীয়ভাবে শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
লেখক- সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদ
Discussion about this post