নাসরীন সুলতানা মিতু
নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা নিয়ে চারপাশে অনেক অনেক আলাপ আলোচনা শুনছি। এত বড় একটা বিষয়-বলতে গেলে দেশের প্রতিটি মানুষের স্বার্থ যেখানে কোনো না কোনোভাবে জড়িত, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা হবেই। সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই উচিত। অন্যদের মতোই দেশের আমজনতার একজন হিসেবে আমার দুই লাইন আলাপ তুলতেই এই লেখা। তবে ঘটনাচক্রে যেহেতু এই গন্ধমাদনসম কাজটায় অল্পস্বল্প জড়িত থাকার সুযোগও ঘটেছিল, দুই লাইনের আলাপ চার লাইনে গিয়ে ঠেকতে পারে— সেজন্য আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
সর্বসাধারণের মতামত নেওয়ার জন্য রূপরেখার একটি খসড়া এনসিটিবির ওয়েবসাইটে গতবছর থেকেই তুলে রাখা ছিল। অনেকেই মতামত দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী বেশ কিছু ঘষামাজাও করা হয়েছে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, আর দশটা সরকারি ডকুমেন্টের মতোই, আমাদের অনেকেরই শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে এই টেকনিকাল জার্গনের কচাকচি ভেদ করে গোটা রূপরেখাটা পড়া হয়ে ওঠে না. এমনকি শিক্ষাবিজ্ঞানের ছাত্র শিক্ষক যারা আছি তাদেরও না। ফলে পত্রিকার হেডলাইনই ভরসা, যা থেকে আবার খুব বেশি ব্যাখ্যা খুঁজে পাবার সুযোগ নেই!
গত বেশ কিছুদিন ধরে এই রূপরেখার যে দিকগুলো নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে যে কথাটি বারবারই শুনেছি তা হল—
নবম-দশমে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগ না থাকলে বিজ্ঞানের গুরুত্ব তো কমে যাচ্ছে, এইচএসসি তে গিয়ে সবাই তো অকূল পাথারে পড়বে।
রূপরেখা নিয়ে গত কিছুদিন এই আলাপটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে। এই আলাপের প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে, প্রথমেই মানবিক ও বাণিজ্য শাখায় পড়া ছেলেমেয়েদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়ে হিসাব করা। তের চৌদ্দ বছর বয়সেই একজন মানুষের বাকি জীবনে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়ালেখা বা ক্যারিয়ার করার সুযোগ চিরদিনের মতো বন্ধ করে দেওয়া অনেক দিক দিয়েই ভীষণ ভীষণ সমস্যাজনক। এখানে যদিও বিভাগ ‘বেছে নেওয়ার’ কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বেশির ভাগ স্কুলে একটা নির্দিষ্ট নম্বর বা সিজিপিএ পেলেই শুধুমাত্র শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ পায়। উল্টোদিকে তথাকথিত সবচেয়ে কম মেধাবীদের বাধ্য করা হয় মানবিক বিভাগে পড়তে। এই বিচ্ছিরি সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি করে তা তো প্রশ্নাতীত। আর বিভিন্ন বিভাগের বিষয়গুলোর প্রতি তাদের কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না!
মানবিক ও বাণিজ্য শাখার শিক্ষার্থীদের সাধারণ বিজ্ঞান নামক যে বিষয়টি পড়ানো হয়, তা কতটুকু গুরুত্ব পায় তা শিক্ষার্থী বা শিক্ষক মাত্রই জানেন। একই কথা আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও খাটে—ইতিহাস, অর্থনীতির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বলতে গেলে সেভাবে না পড়েই আমরা অনেকেই এই বয়স পর্যন্ত চলে এসেছি। সামাজিক বিজ্ঞান নামক একটা বিষয় আমাদেরও ছিল বটে— কিন্তু তা শুধুমাত্র পাশ করার জন্য জোড়াতালি দিয়েই পড়া হতো যদ্দূর মনে পড়ে। যেহেতু বাকি শিক্ষাজীবন এই সব বিষয় ‘কাজে লাগবে না’ ধরে নেওয়া হতো, কোনোরকমে পরীক্ষা হল পর্যন্ত পার হওয়াটাই ছিল সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য। নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী সকল শিক্ষার্থী দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন দশটি বিষয় পড়বে। (এই দশটি বিষয় নির্ধারণ করতে কী কী ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে তার বিস্তারিত লিখছি না, কেউ কৌতূহলী হলে রূপরেখার খসড়া পড়ে দেখতে পারেন)। শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন দশটা বিষয় পড়ার পর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজেদের ক্যারিয়ার প্ল্যান অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভালো, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়েও আগের মতো বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগের মধ্যে বেছে নিতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং সবার জন্য সব বিষয় নেওয়ার সুযোগ থাকবে; অর্থাৎ কেউ যদি চায় পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে পড়বে—সেই সুযোগও থাকবে।
তাহলে বিজ্ঞান নিয়ে যারা পরবর্তীতে পড়বে বা ক্যারিয়ার গড়বে তাদের কী হবে? নবম-দশম শ্রেণিতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান আলাদা তিনটি বিষয় ছিল, এখন তা যেহেতু থাকছে না; উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে যারা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়বে তারা ধাক্কা খাবে কি না! বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার যে গুরুতর অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে এই রূপরেখার বিরুদ্ধে, তার ভিত্তি এই প্রশ্নেই। অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ মোটা দাগে দেখলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আগে তিনটি বিষয় পড়ত, এখন সমন্বিত একটা বিজ্ঞান বিষয়ে ওই একই পরিমাণ বিষয়বস্তুর কভারেজ হবে কি না সে প্রশ্ন তোলাই যায়। আবার উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে প্রচলিত সিলেবাসেই যেখানে সবার খাবি খেতে হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে এই ধাক্কা সামলানোর ব্যবস্থা কী হবে তা অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
এই প্রশ্নের দুই রকম উত্তর আছে। শুরুতে একেবারে সাদা চোখে দেখা যায় এমন দিকগুলো দেখা যাক। প্রথমত, শিক্ষাক্রমে দশটি বিষয় থাকলেও সব শ্রেণিতে সকল বিষয়ের গুরুত্ব সমান নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাতৃভাষার উপর দখল ও গাণিতিক দক্ষতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সময় বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সেই বিবেচনায় বাংলা ও গণিতে বেশি সময় ধরা হয়েছে। আবার নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সমন্বিত বিষয় বলে দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সময় বরাদ্দ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যেহেতু প্রথমবারের মত পদার্থবিজ্ঞান বা ইতিহাসের মত বিশেষায়িত বা স্পেশালাইজড বিষয়গুলো বেছে নেয়ার প্রশ্ন আসবে, এবং পাশ করার পর পরই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, কাজেই এই স্তরে বিশেষায়িত বিষয়ের উপর গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থায় এই স্তরে সবাইকেই বাংলা ও ইংরেজি দুই পত্র করে, এবং আইসিটি এক পত্র আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পড়তে হয়। নতুন রূপরেখায় এই আবশ্যিক বিষয়গুলোর ধরন পাল্টানোর পাশাপাশি এদের গুরুত্ব ও বরাদ্দকৃত সময় অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়েছে। তার মানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা যেসব বিশেষায়িত বিষয় বেছে নেবে সেগুলোর উপরেই বেশি জোর দেওয়া হবে; এমনকি এই বিষয়গুলোর পাঠ্যক্রম তৈরির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের বিষয়সমূহের পাঠ্যক্রম ও সেখানে ভর্তির পূর্বযোগ্যতার সঙ্গে সমন্বয় করার কথাও বলা হয়েছে যাতে কোনভাবেই ছেলেমেয়েরা দুর্ভোগের মধ্যে না পড়ে!
এ তো গেল মোটা দাগে যে বিষয়গুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো। এখন আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক! ছোটবেলায় দেখতাম ক্লাসের ভালো ছাত্ররা বিজ্ঞানের সব দাঁতভাঙা কনসেপ্ট দুলে দুলে মুখস্থ করত, যে ছাত্র যত সিরিয়াস তার পড়ার গতি ও আওয়াজ দুই-ই বেশি। সময়ের সঙ্গে শিক্ষার মান বেড়েছে না কমেছে বলতে পারব না, তবে এই কষ্টসাধ্য ব্যাপারটা হয়ত কিছুটা কমেছে (অন্তত আশেপাশের স্কুলপড়ুয়াদের আওয়াজ শুনে তাই মনে হয়)। তবে ক্লাসে পড়ানোর ধরনের কতটা উন্নতি হয়েছে তা এখনো প্রশ্নের দাবি রাখে। গত কয়েক দশকে স্কুল পর্যায়ে কারিকুলামে ছোট ছোট অনেক পরিবর্তন আসলেও ক্লাসে পড়ানোর যে ধরন, তাতে বড় কোনো পরিবর্তন এখন পর্যন্ত অন্তত আমার চোখে পড়েনি। এখানে বলে রাখা ভালো, বর্তমান প্রচলিত কারিকুলামে শেখার এবং শেখানোর বেশ কিছু তত্ত্ব, পদ্ধতি, কৌশল ইত্যাদি উল্লেখ করা আছে; কিন্তু পাঠ্যবইকেন্দ্রিক পড়াশোনা হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে শুধুমাত্র পাঠ্যবই (এবং অনেকক্ষেত্রেই গাইডবই) এর উপরেই নির্ভর করেন; কারিকুলাম বা শিক্ষক সহায়িকা বেশির ভাগ শিক্ষকের কখনো খুলে দেখাও হয়ে ওঠে না।
নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো উচ্চারিত হয়েছে তারমধ্যে একটা হলো ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন’। সাদামাটাভাবে বুঝতে গেলে ব্যাপারটি খুবই সহজ। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে নানা কিছু শিখছি। যেকোনো তথ্য বা তত্ত্ব মুখস্থ করতে আমাদের যতটা পরিশ্রম হয়, তার চেয়ে অনেক কম পরিশ্রম হয় যদি আমরা সত্যিকারের কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিষয়টা শিখি। এতে শেখার কাজটা শুধু সহজ হয় তাই নয়, বরং বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই পুঁথিগত বিদ্যার একটা সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া যায়, ফলে এই শেখাটা অনেক বেশি স্থায়ী হয়। শিক্ষার্থীদের সরাসরি জ্ঞানের বোঝা না চাপিয়ে এরকমভাবে যদি বিভিন্ন প্ল্যানড অ্যাক্টিভিটি ডিজাইন করা হয়, যার মাধ্যমে তারা কোনো সত্যিকারের সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানবে, শিখবে—তাহলে নিশ্চয়ই শেখার অভিজ্ঞতাটা অনেক আনন্দের হবার কথা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো—সত্যিকারের অভিজ্ঞতায় আমরা আসলে কখনই নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের জ্ঞান আলাদা আলাদাভাবে শিখি না। বরং বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আমাদের বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি নানা বিষয়ের জ্ঞান বা দক্ষতা একইসঙ্গে কাজে লাগাতে হয়। কাজেই স্কুলের পড়ালেখা যদি বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে পরিকল্পনা করা হয়, তাতে একইসঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ তৈরি হয়। অর্থাৎ সাদা চোখে আমরা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের জন্য যেই সময় বরাদ্দ দেখতে পাই, সত্যিকার অর্থে শিখনের সময় তার চেয়েও বেশি। কারণ অন্যান্য বিষয়ের জন্য বরাদ্দ করা সময়েও ওই বিষয়ের শিখন চালু থাকতে পারে! (পাঠক আগ্রহী হলে বিভিন্ন দেশের ক্লাসরুমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের বিভিন্ন কৌশল-যেমন প্রজেক্ট বেজড লার্নিং এর কিছু উদাহরণ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখতে পারেন)।
নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষাসহ অন্যান্য সকল বিষয়ের গুরুত্ব কমছে না বাড়ছে তার উত্তরটা একটু গভীরে গিয়ে খুঁজতেই উপরের এই বিশাল আলাপের অবতারণা! কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বেশি-কম হিসেব করতে সাধারণভাবে আমরা যা দেখি তা হলো বিষয়বস্তুর কাভারেজ, অর্থাৎ সিলেবাসে কী পরিমাণ টপিক বা বিষয়বস্তু দেওয়া আছে। নতুন শিক্ষাক্রম যেহেতু এখনো প্রণীত হয়নি, এর রূপরেখা বা ফ্রেমওয়ার্ক অনুমোদন পেয়েছে মাত্র— আমরা এখনো জানি না সেখানে কোন ক্লাসে এই কাভারেজ কতটা থাকবে। রূপরেখায় সং—গত কারণেই কোন বিষয়ের ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তু কী থাকবে বা বাদ যাবে তার কোন উল্লেখ নেই। যা আছে তা হলো, নতুন শিক্ষাক্রমের এক একটি বিষয়কে কীভাবে চিন্তা করা হয়েছে, এই বিষয়গুলো রাখার যুক্তি ও উদ্দেশ্য কী, বিষয়গুলো এপ্রোচ কেমন হবে, শিক্ষার্থীরা এই বিষয় থেকে আদতে কী শিখবে ইত্যাদি। সেদিক দিয়ে দেখলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই যে কথা বলা যায় তা হলো, কোনোভাবেই এই বিষয়ের গুরুত্ব কমছে না। বরং বিজ্ঞান বিষয়টিকে টুকরো টুকরো বিষয়বস্তুর সংকলন হিসেবে না দেখে আরো বৃহৎ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। একগাদা থিওরি মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশ করার বদলে সত্যিকারের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আত্মস্থ করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এতে আসলে কী লাভ হবে? বিজ্ঞান আমরা আসলে কেন পড়ি? এই আলোচনায় যাবার আগে এই ফ্রেমওয়ার্কের আরো কিছু দিক নিয়ে আলাপ করাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিজ্ঞান বিষয়টিকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই, এদেশের বিজ্ঞান শিক্ষাক্রমে আমরা কোথায় ফোকাস করতে চাই, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী— অর্থাৎ এর মাধ্যমে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের কোথায় পৌঁছে দিতে চাই এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সেই অনুযায়ী শিক্ষাক্রম সাজানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা বিজ্ঞান বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কিছু বিষয়বস্তুর যোগফল হিসেবেই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।
এই শিক্ষাক্রম রূপরেখায় প্রতিটি বিষয়ের আলোচনার শুরুতে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যদি বলি, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কখনই বিজ্ঞানী তৈরি করা নয়। বরং বিজ্ঞান একটি চর্চার বিষয়, যে চর্চার মাধ্যমে একজন মানুষ বিজ্ঞানের চশমায় তার আশেপাশের সমস্তকিছুকে দেখতে শেখে, ব্যাখ্যা করতে শেখে। যুক্তি, পর্যবেক্ষণ বা হাতেকলমে প্রমাণের ভিত্তিতে কোনো বিষয়ের উপসংহারে পৌঁছানো, ক্রিটিকালি চিন্তা করতে শেখা, কোনো কিছুকে পরম হিসেবে ধরে না নিয়ে বরং যুক্তির কাঠগড়ায় বিচার করতে শেখা, এই যোগ্যতাগুলো মানুষের রাতারাতি তৈরি হয় না। বরং দিনের পর দিন চর্চার মাধ্যমে আস্তে আস্তে চিন্তা শাণিত হয়। এই চর্চার অভাবেই প্রচুর পরিমাণ বৈজ্ঞানিক তথ্য মুখস্থ করেও অনেক বিজ্ঞানের শিক্ষকেরও ঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা করতে শেখা হয়ে ওঠে না। তারা যুক্তির বদলে বিশ্বাস থেকে গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি গুলিয়ে ফেলে কথায় কথায় বিজ্ঞানকে শাপশাপান্ত করে, আর অসুখবিসুখ হলে জ্বিনের আছর বলে ধরে নেয়। এই সমস্ত কিছু বিবেচনায় নিয়েই বিজ্ঞান বিষয়টিকে এই রূপরেখায় এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল জীবনের পুরোটা সময় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের একটা ধারাবাহিক চর্চার মধ্যে থাকে। ফলে তাদের পরবর্তী শিক্ষাজীবন বা ক্যারিয়ারে যদি বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে আর কোন সংশ্রব নাও থাকে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা যেন যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে মতামত দিতে বা সিদ্ধান্ত নিতে শেখে।
এ পর্যন্ত পড়ে আমরা যাতে বিজ্ঞানকে খুব কাঠখোট্টা বিষয় হিসেবে ধরে না নিই। বরং বিজ্ঞান শিক্ষাক্রম এমনভাবে সাজানোর কথা বলা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের আশেপাশের সবকিছুর প্রতি কৌতূহলী হয়ে ওঠে। মজার বিষয় হল, শিশু মাত্রই কৌতূহলী, বরং স্কুলের প্রথাগত শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা তাদের একটা বাঁধাধরা চিন্তার ছাঁচে ফেলে দিই, তার কৌতূহলকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। ছোটবেলায় আমার বাবার গ্রামের একজন দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আগুন জিনিসটা কী? তিনি উত্তর দিতে পারেন নি ঠিক, কিন্তু প্রশ্নটা উড়িয়ে দেন নি, প্রশ্নটা তাই মনেই জমা ছিল। পরে স্কুলে ভর্তি হবার পর ক্লাসে বিজ্ঞান স্যারকে এই প্রশ্ন করে উত্তর তো পেলামই না, বরং হালকা তাচ্ছিল্য গায়ে মাখতে হয়েছিল, এর পরে আর কাউকে এই প্রশ্ন করার সাহস পাইনি। আমার ছোটবেলার অন্যতম দুঃখের স্মৃতি এটা। শিক্ষাক্রম রূপরেখার কাজ করতে গিয়ে বার বারই এই কথা মনে পড়ছিল।
শিশুর কোন প্রশ্ন বা কৌতূহলকে আমরা আর দূরে ঠেলতে চাই না। বরং শিশুর চোখে আমরাও এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড দেখতে চাই। শিশুরা যেমন পরম কৌতূহলে মহাবিশ্বের বৈচিত্র্য দেখে উদ্বেলিত হয়, ফুল ফুটতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়, আকাশের অগণিত তারা গুণতে গিয়ে বিহ্বল হয়- সেই কৌতূহল, সেই উচ্ছ্বাস, শিশুমনের সেই তীব্র আবেগ আমরা পরম যত্নে লালন করতে চাই। বিজ্ঞান শিক্ষাক্রমের এই স্বপ্ন আমাদের প্রেক্ষাপটে উচ্চাশা তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু পথেই না নামলে গন্তব্যে পৌঁছুব কী করে?
লেখার এই পর্যন্ত যারা পড়েছেন, নির্ঘাত তাদের সবার মনেই একই প্রশ্ন এসেছে- অনেক ভাল ভাল কথা তো বলা হল, কিন্তু এই উচ্চাভিলাষী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হবার প্রক্রিয়াটা কী হবে? রূপরেখাটির খসড়া যারা কষ্ট করে পড়েছেন তারা জানেন, বাস্তবায়নের কঠিন চ্যালেঞ্জ মেনে নিয়েই তা মোকাবেলার বেশ কয়েকটি সুস্পষ্ট কৌশল এখানে উল্লেখ করা আছে। এবং সম্ভবত এই প্রথম বাংলাদেশে কোন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় শিক্ষকদের প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই রূপরেখার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর থেকে শুরু করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিটি এজেন্সিকে একই সুতায় গেঁথে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। অতি সম্প্রতি যে জাতীয় শিক্ষাক্রম বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছে তাও বোধ করি এই সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্যেই।
সবকিছুর পরেও কাজটা সহজ নয় ঠিক, হয়ত এতকিছুর পরেও বাস্তবায়নের শুরুর দিকে কিছু হোঁচট খেতে হতে পারে। তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে, পৃথিবীর কোথাও শিক্ষাক্রমের এরকম পরিবর্তন সহজে হয়নি, রাতারাতি হয়নি। আমাদের এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নও এক ধাক্কায় হবেনা, ২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমান্বয়ে এই বাস্তবায়ন চলবে, এই সময়ের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও ক্রমান্বয়ে এই নতুন ধারার শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে হবে, আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক, নীতিনির্ধারক, প্রশাসক সবাইকেই এই পরিবর্তনের সাথী হতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন, বাস্তবায়ন ইত্যাদি আরো বিস্তারিত আলাপের দাবি রাখে, তবে আজ আর সেদিকে যাচ্ছি না। আপাতত এই লেখার এখানেই ইতি টানা যাক বরং।
লেখক: কার্টুনিস্ট ও শিক্ষাকর্মী
Discussion about this post