দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ
ওবায়েদ উল হক; পরিচয় তার বহুমাত্রিক। তিনি একাধারে লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, সুরকার, গীতিকার। বলা যায়, ইত্যাদি ছাপিয়েও তিনি একজন সব্যসাচী সাংবাদিক। তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৫ সালে, আর সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য একুশে পদক অর্জন করেন ১৯৮১ সালে।
এ ছাড়া তার অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে আরও সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯১১ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি ফেনীর এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর তার প্রয়াণ ঘটে। ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েই থেমে থাকেননি। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাপ্ত করেন আইন কোর্স। ১৯৩৮ সালে সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও সেখানে থিতু হননি। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ তার চিন্তার জগতে নাড়া দেয় প্রচণ্ডভাবে। এ থেকেই হাত দেন চলচ্চিত্র নির্মাণে এবং ১৯৪৬ সালে তার ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ ছবিটি মুক্তি পায়। তখনকার সময় একটি সিনে ম্যাগাজিন জরিপে ১০টি সেরা ছবির মধ্যে স্থান করে নেয় তার নির্মিত এ ছবিটি।
এর পর শুরু করেন সাংবাদিকতা। আমাদের জাতীয় জীবনের বাঁক পরিবর্তনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ভাষা আন্দোলনের প্রায় এক বছর আগে যুক্ত হন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের সঙ্গে। সেখান থেকেই স্বাধীনতাউত্তর ওই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি নিউজের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রায় পাঁচ বছর। এর পর নিযুক্ত হন দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমসের বোর্ড অব ট্রাস্টের চেয়ারম্যান পদে। তার তিনটি উপন্যাস, তিনটি কাব্যগ্রন্থ, ইংরেজিতে আত্মজীবনীসহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১৪। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার খ্যাতির বিস্তৃত সীমানায় তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত। সাংবাদিকতায় অধিক উজ্জ্বল ওবায়েদ উল হক নিজেই বলে গেছেন- ‘আমি বাই চয়েস জার্নালিস্ট নই, আমি বাই চেঞ্জ জার্নালিস্ট।’ কারণ তার সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় ছিল না। লেখালেখির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সত্ত্বেও। এই ভূখণ্ডে অনেক লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক একেবারে জীবনসায়াহ্ন পর্যন্ত নিজেকে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। এর মধ্যে ওবায়েদ উল হক অন্যতম। ৯৬ বছর বয়স পর্যন্ত বলতে গেলে তিনি প্রায় নিরলস ছিলেন লেখালেখি কিংবা তার সৃজনশীলতা প্রকাশে বিভিন্ন মাধ্যমে। বয়সের ভারে তিনি নুইয়ে পড়েননি। তিনি আমাদের নির্বাপিত এক বহুমাত্রিক প্রতিভা। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনউত্তর সৃষ্ট সংকটজনক পরিস্থিতিতে যখন এ জনপদের বিভিন্ন অংশে বিপন্ন মানবতার প্রতিচ্ছবি শুভ বোধসম্পন্নদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ উচ্চকণ্ঠ করে তুলেছিল, তখন বিদ্যামান পরিস্থিতি নিয়ে তার কয়েকটি লেখার শ্রুতিলিখন করেছিলাম। তখন আমি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কর্মরত।
তার গভীর দৃষ্টি ছিল সমাজের অবহেলিত-বঞ্চিতদের প্রতি নিবিষ্ট। তার নির্মিত অন্যতম চলচ্চিত্র ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’য় এরই প্রতিফল ঘটেছে। তার গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটকেও অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের প্রতি দরদ আর বঞ্চনার প্রতিবাদ বিধৃত। তার রচিত নাটক ‘দিজ্ঞ্বিজয়ে চোরাবাজার’, ‘রুগ্ণ পৃথিবী’, ‘যুগসন্ধি’ কিংবা উপন্যাস ‘সংগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বিধার ফসল’, ‘ছায়ানগর সংলাপ’ ইত্যাদি এরই সাক্ষ্যবহ। বলা যায়, ব্যাপক পঠন থেকে গড়ে ওঠা তার মননের প্রতিটি সৃষ্টিতেই ছিল প্রতিভার উজ্জ্বল ছাপচিত্র। তার সৃষ্টি কিংবা বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের ধাপে ধাপে যে ছাপচিত্র রয়েছে, তা আমাদের পথ দেখায়, অনুপ্রেরণা জোগায়, অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। তিনি তার লেখায় মোক্ষম উদ্ৃব্দতির মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে তির্যক করে তোলার ক্ষেত্রে ছিলেন দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার কাজ ও সময়কে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন। অনেক অনুজই তার স্নেহার্দ্র হাতের ছোঁয়ায় বিকশিত হয়েছেন। যুগদ্রষ্টা, কালদ্রষ্টা, স্বাপ্নিক ইত্যাদি শব্দ কোনো কোনো ব্যক্তি-মানুষের পরিচয়ের অভিধা হয়ে ওঠে। ওবায়েদ উল হক তেমনই একজন। বিনম্র শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করি।
লেখক ও সাংবাদিক
Discussion about this post