সজীব ওয়াফি
সমুদ্র শহর কুয়াকাটার সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের নতুন দুয়ার খুললো পায়রা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ অক্টোবর পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর নির্মিত চার লেইনের এ সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ঢাকায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, পায়রা সেতুতে সশরীরে উপস্থিত থেকে যদি তিনি উদ্বোধনের এই আনুষ্ঠানিকতা সারতে পারতেন, যদি গাড়ি চালিয়ে সেতু পার হতে পারতেন, তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু মহামারির মধ্যে ‘একপ্রকার বন্দি জীবনে’ তা সম্ভব হয়নি।
প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু চালু হওয়ায় সড়কপথে সরাসরি কুয়াকাটা পৌঁছানো আরও সহজ হলো। বরিশালের সঙ্গে পটুয়াখালী ও বরগুনার সড়ক যোগাযোগে ফেরি পারাপারের ভোগান্তি কমানোর পাশাপাশি সময় ও অর্থ বাঁচাবে এ সেতু। একসময় সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা যেতে দশটি ফেরি পার হতে হতো। বিগত বছরগুলোতে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এই পথে বাকি ছিল কেবল দুটি ফেরি। এরমধ্যে পায়রা নদীতে সেতু চালু হওয়ায় এখন বাকি থাকল কেবল পদ্মা। আগামী বছর পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে কোনো ফেরি পারাপার ছাড়াই ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা যাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সরকার ও কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের যৌথ অর্থায়নে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লংজিয়ান রোডস অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি’ সেতুটি নির্মাণ করেছে। দৃষ্টিনন্দন এ সেতু নির্মণ করা হয়েছে ‘এক্সট্রাডোজড কেবল স্টেইড’ প্রযুক্তিতে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতুও একই পদ্ধতিতে নির্মিত। এক্সট্রাডোজড কেবল স্টেইড প্রযুক্তিতে দেশের দ্বিতীয় পায়রা সেতু। মেগা প্রকল্পের অন্তর্গত পটুয়াখালীর পায়রা নদীর উপর নির্মিত এই সেতু ইতিমধ্যে যুক্ত করেছে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা। বড়সড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে অর্থনীতিতে। এটি চালু হওয়ায় দেশের যে কোন স্থান থেকে সর্বদক্ষিণে উপকূলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সহজ হয়ে গেছে। সড়ক পথের যাত্রী ও যানবাহন চালকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর অপেক্ষা করতে হবে না। ভোগান্তি কমবে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের। সামগ্রিক প্রভাব ফেলবে জিডিপিতে। পায়রা নদীর লেবুখালী নামক স্থানে লেবুখালী-পটুয়াখালী যুক্ত করায় সেতুটিকে লেবুখালী সেতু হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে।
পায়রা নদীর উপরের চারলেনের এই সেতু কেবল দিয়ে দুইপাশে সংযুক্ত। মাঝখানে আছে একটি মাত্র পিলারের ব্যবহার। বসানো হয়েছে পদ্মাসেতু থেকেও বড় দু’টি স্প্যান। জলতল থেকে সেতুর উচ্চতা ১৮ দশমিক ৩০ মিটার। ফলে নৌ চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ১৩০ মিটার গভীর পাইলিং করে বসানো হয়েছে পিয়ারটি। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ থেকে সেতুকে নিরাপদ রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ব্রিজ হেলথ মনিটর’। এ প্রযুক্তিতে সেতুর ক্ষতি হতে পারে এমন অতিরিক্ত ভারি যানবাহন সেতুতে উঠলেও বেজে উঠবে বিপদ সংকেত। এক হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট সেতুটির নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। যার উভয় দিকে ৭ কিলোমিটার জুড়ে আছে অ্যাপ্রোচ সড়ক। আছে রেল যোগাযোগের সুবিধা। নদীর মধ্যে মূল ব্রিজ মূলত ৬৩০ মিটার। যা তৈরি হয়েছে ইস্পাত ও কংক্রিট দিয়ে। সেতু আলোকিত করা হবে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে।
পায়রা সেতুর জন্য পটুয়াখালীবাসীর অপেক্ষা দীর্ঘদিনের। এ সেতু নির্মাণের জন্য একনেকে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল সেই ২০১২ সালের ৮ মে। ৫ বছরের প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে নয় বছর, ব্যয় বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। দীর্ঘ প্রত্যাশার এ সেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণ জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটবে এবং পায়রা বন্দরের অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও বেগবান হবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার।
সেতু উদ্বোধন হওয়ায় পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার কয়েকটি উপজেলা এবং সাগর কন্যা কুয়াকাটার সঙ্গে বরিশাল তথা সমগ্র বাংলাদেশের সঙ্গে তৈরি হলো সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। আগের চেয়ে ২-৩ ঘণ্টা কম সময়ের ভিতরেই সৈকতে পৌছতে পারবে পর্যটকেরা। ব্যবসায়িক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আসবে বড় রকমের পরিবর্তন। নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ব্যবস্থায় বিভাগীয় শহরের সাথে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে সাধারণ জনগণ। চিকিৎসা সেবা পেতেও ঝামেলা ঝক্কির মুক্তি মিলবে অবহেলিত দক্ষিণ জনপদের। সেতুর পাশাপাশি লেবুখালী এলাকায় তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। পাশেই চলছে শেখ হাসিনা সেনানিবাসের কাজ। দিনে দিনে সম্প্রসারণ ঘটছে নানান ধরনের ব্যবসায়। রাস্তার পাশে তৈরি হচ্ছে হোটেল, তেলের পাম্প। জমির মালিকেরাও তাদের জমি ঘিরে অর্থনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে জোরেশোরে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত পায়রা বন্দর পুরোদমে চালু হওয়া নির্ভর ছিলো পায়রা সেতুর ওপর। সেতুটি চালু হওয়ায় অত্রাঞ্চলে দ্রুত শিল্পের প্রসার ঘটবে। আগের তুলনায় সময় কম লাগায় কমে আসবে খরচও। কমবে ঢাকামুখী পণ্যের মূল্য। পাওয়া যাবে খুব সহজেই। তৈরি হবে টাইম ভ্যালু মানি। চাঞ্চল্যময় হয়ে উঠবে দক্ষিণের অর্থনীতি। উন্নয়নে রূপান্তর ঘটবে দুর্গম উপকূলবাসীর জীবনযাত্রার মান। ধান, তরমুজ, বাঙ্গিসহ মৌসুমি কৃষি পণ্য সেতু হয়ে সহজেই বরিশালে এসে দূরদূরান্তের বাজারে পৌঁছতে পারবে। বাজারজাতকরণে শাক সবজি পঁচে যাওয়ার ভয় আর থাকবে না। কৃষকরাও পাবে ন্যায্য দাম। শৃঙ্খলা তৈরি হবে সুষম বণ্টনের। মোদ্দাকথা যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণের মাধ্যমে সম্ভাবনা তৈরি হবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে।
খরস্রোতা পায়রায় সেতুর একটি পিলার ব্যবহারের ফলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু সার্বিক অবকাঠামোগত কারণে খরস্রোতে ভাঙ্গনের কবল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে পায়রা পাড়ের মানুষেরা। নদীগর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পাবে গ্রামের পর গ্রাম। উদ্বাস্তু হওয়ার চিন্তা থেকে অনেকটা মুক্তি মিলেছে তাদের। অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের এরকম ইতিবাচক ঊষালগ্নে, সেতুর নামকরণ প্রসঙ্গে বরিশালবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তারা মানববন্ধন-সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক এবং রাজনৈতিকসহ নানা পেশার লোকজন। তারা চেয়েছিলেন সেতুর নাম হবে ঊনসত্তরেরর গণঅভ্যুত্থানে বরিশালের প্রথম শহিদ আলাউদ্দিনের নামে। তাদের দাবি রক্ষা হয়তো সম্ভব হয়নি। গুণীজনদের হাহাকার এবং শহিদের সম্মানার্থে ভবিষ্যতে বিশেষ কোন স্থাপনা হোক।
দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি হয়ে পায়রা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে। এখন কেবল চোখের সামনে আলাদীনের চেরাগের মতো দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিবর্তনের অপেক্ষা। জিডিপি’র ১০ শতাংশের ১৫ থেকে ২৫ ভাগ যোগান আসবে এই এক সেতু পুরোদমে ভূমিকা রাখতে পারলেই। যাতায়াত, শিল্প, বাণিজ্য ও পর্যটনে অকল্পনীয় বিপ্লব দক্ষিণের জনপদে অবশ্যম্ভাবী। পায়রায় চলুক দুর্দান্ত সোয়ার!
লেখক: কলামিস্ট
Discussion about this post