ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ি প্রতি বছরের ২০ নভেম্বর বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে বিশ্ব শিশু দিবস উদাযাপিত হয়ে থাকে। এবারের বিষয় হলো ভবিষ্যতের বিনিয়োগই শিশুদের জন্য বিনিয়োগ (Investing in our future means investing in our children)। শিশুদের মধ্যে সচেতনতা এবং তাদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।
জাতিসংঘের ইতিহাসে ২০ই নভেম্বর শিশুদের অধিকার রক্ষার্থে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
আমরা এ দিবস পালন কালে শুধু শিশুদের অধিকার রক্ষা ও কল্যানকামিতার কথা বলি। কিন্তু তাদের সামগ্রিক উন্নতির জন্য তাদের নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা যে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে আমরা কমই সচেতন থাকি। এটি অস্বিকার করার উপায় নেই যে, আমরা এখন ডিজিটাল যুগে বাস করছি এবং আমাদের সন্তানেরাও বেড়ে উঠছে ডিজিটাল কালচারের প্রভাবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে ডিজাটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে, পিতামাতারা তাদের অভিভাবকত্বে দিন দিন দিশেহারা হয়ে উঠছেন।
সন্তানরা যেন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং নৈতিকভাবে পদস্খলিত হচ্ছে। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি নিবন্ধ এই পদস্খলনের জন্য কর্মজীবী বাবা-মাকে দায়ী করে, যারা ব্যক্তিগতভাবে তাদের বাচ্চাদের নৈতিক মূল্যবোধ শেখাতে খুব ব্যর্থ। গুড প্যারেন্টিং এর অভাবে, শিশুরা টিভি শো এবং অনলাইন ভিডিও থেকে অনেক ভুল কিছু সম্পর্কে শিখে থাকে যা তাদের বয়সের জন্য অনুপযুক্ত৷ বর্তমান যুগে তাদের চারপাশে খুব বেশি বিভ্রান্তি রয়েছে যা তাদের বিপথে নিয়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, বাচ্চারা স্পঞ্জের মতো, তারা যা দেখে বা শোনে তা শুষে নেয়। সুতরাং আমাদের উচিত তাদেরকে নৈতিক মূলুবোধ শিক্ষার মাধ্যমে সঠিক পথে চালিত করা।
নৈতিকতা বা মোরালিটি হল আমাদের নিজস্ব অনুভূতি যা কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল তা ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নির্ণিত হয়। আর নৈতিক মূল্যবোধ হল ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য যা আমাদেরকে সঠিক বা ভুলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে কার্যকরি বিচার ও সিদ্ধান্ত নিতে নির্দেশ দেয়। যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের আলাদা অভিজ্ঞতা আছে, তাই নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হতে পারে।
এ কারণেই বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতিতে আমাদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং বেশিরভাগ সময়, একজন ব্যক্তির মূল্যবোধগুলি সে যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তার প্রতিফলন হিসেবে বিস্তৃত হতে পারে। শিশুদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব জীবনের যে পর্যায়েই হোক না কেন তা অনেক বেশি। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমাদের যে মূল্যবোধ আছে তার বেশির ভাগই শৈশবকালেই ভালো প্যারেন্টিং এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
এ কারণেই এটা অপরিহার্য যে আমরা আমাদের সন্তানদের সেই মূল্যবোধ শেখাই যা আমরা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে পেতে চাই। বিভিন্ন কারনেই শিশুদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে ভালো প্যারেন্টিং এর গুরুত্ব অনেক বেশি।
প্যারেন্টিং কৌশলে নৈতিক মূল্যবোধ যেমন দয়া, নম্রতা, সাহস এবং সমবেদনা অল্প বয়সে জানা শিশুর
চরিত্র গঠন করে। এটি তাদের সত্তার মূল গঠন করে এবং তাদের নৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
এই মূল্যবোধগুলি সন্তানদেরকে সেভাবেই গড়ে যেভাবে পিতামাতা তাদেরকে দেখতে চান।
নৈতিক মুল্যবোধের শিক্ষা সন্তানদেরকে ভুল থেকে সঠিক বলতে সাহায্য করে। শৈশবকালে ভালো
প্যারেন্টিং এর শিক্ষা না পেলে সন্তানদের মধ্যে নাবা অপরাধ প্রবনতা কাজ করে। ২০১৯ সালে দ্য
গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন কিছু শিশুদের সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, যারা ছোটখাটো
চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলো। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, তাদের অধিকাংশই একজন অভিভাবককে হারিয়েছে বা তাদের একজনও ছিল না। তাদের গাইড করার এবং তাদের সঠিক মূল্যবোধ শেখানোর জন্য কোন প্যারেন্টিং তারা পায়নি। এগুলি সেসকল শিশুদের উদাহরণ যাদের সঠিক এবং ভুলের কোনও ধারণা নেই। তারা সাধারণত বলতে পারে না যে কোন জিনিসগুলি নৈতিকভাবে সঠিক এবং কোনটি নয়। কারন তারা কখনো ভালো প্যারেন্টিং এর শিক্ষা পায়নি।
ভালো প্যারেন্টিং এর ফলে নৈতি মূল্যবোধের শিক্ষা বিশ্ব সম্পর্কে সন্তানদের ধারণা পরিবর্তন করে
দেয়। শিশুরা যখন সঠিক থেকে ভুল বলতে পারে, তখন তারা খারাপ থেকে ভালোও নির্ধারণ করতে পারে;
প্রয়োজন শুধু ভালো প্যারেন্টিং এর। এটি বিশ্ব সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি গঠনে সহায়তা করে। যে
শিশুর একটি দৃঢ় নৈতিক কম্পাস আছে এবং সে যখন কোনো অন্যায় ঘটতে দেখে, তখন শুধু অলসভাবে
দাঁড়িয়ে থাকবে না বরং তারা যেভাবে পারে তা সংশোধনের জন্য কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
প্যারেন্টিং কৌশলে নৈতিক মূল্যবোধ সন্তানদেরকে ভবিশ্যত আচরণ সম্পর্কে সুনির্দেশনা দিয়ে
থাকে। খ্রিস্টান বাইবেলের একটি বিখ্যাত উক্তিতে বলা হয়েছে; একটি শিশুকে যে পথে যেতে হবে
সেভাবে প্রশিক্ষণ দিন এবং যখন সে বৃদ্ধ হবে, তখন সে তা থেকে সরে যাবে না। (প্রবাদ 22:26)
ইসলাম ধর্মেও শিশুদের আদর্শ মানুষ বানাতে ভালো প্যারেন্টিং এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটি
একটি অনুস্মারক যে আজ আমরা সন্তানদেরকে যে মূল্যবোধগুলি শেখাবো তা নির্ধারণ করবে তারা
যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন তারা কীভাবে আচরণ করবে।
গুড প্যারেন্টিং এ নৈতিক মূল্যবোধ সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব বা সমবয়সীদের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত
থাকতে সাহায্য করে। শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা সাধারণত তাদের বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
পোশাক শৈলী, আচার-আচরণ ও চলন-বলনে একে অন্যের অনুকরণ করতে শিশুরা বেশি পছন্দ করে।
সুতরাং কারোর কোন কুসংশ্রব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে শৈশবকাল থেকেই সন্তানদেরকে নৈতিক
মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। কানাডিয়ান স্বাস্থ্য সাইটের মতে, যেসব শিশু নিজেদের সম্পর্কে ভালো
বোধ করে তারা নেতিবাচক সহকর্মীর চাপ প্রতিরোধ করতে বেশি সক্ষম। এছাড়াও, যেসব শিশুরা দৃঢ়
নৈতিক ভিত্তি নিয়ে বড় হয়েছে তারা নিজেদের মধ্যে আরও নিরাপদ। তারা খুব কমই প্রবণতা অনুসরণ
করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, যার ফলে তাদের খারাপ প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক
কম থাকে।
জীবনের শুরুতে শিশুরা সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা না পেলে তারা বাস্তব জীবনে কঠিন সমস্যায় পড়তে
পারে। প্যারেন্টিং কৌশলে মোরাল লেসন পেলে তারা সহজেই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম
হয়। আমাদের তরুণরা আজ সবচেয়ে বেশি যে চাপা উদ্বেগের মুখোমুখি হয়, তা হল বিষণ্নতা।
স্ট্রেসপূর্ণ পরিস্থিতি তাদের কাউকে কাউকে সংকটময় সংগ্রামে ফেলে দিতে পারে এবং এটি ঐ সকল
শিশুদের জন্য আরও গুরুতর হতে পারে, বিশেষ করে যারা তাদের জীবনে খুব বেশি প্যারেন্টিং এর ভালো
তত্ত্বাবধান পায়নি। শিশুদেরকে ভাল থেকে খারাপের পার্থক্য করতে শেখানো এবং মন্দকে মন্দ বলার
শিক্ষা নৈতিক মূল্যবোধের একটি গুরত্বপূর্ণ দিক।
নৈতিক মূল্যবোধ শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ভালো কিছু করা সন্তানদের নিজেদের সম্পর্কে
ভালো বোধ করতে সাহায্য করে। যেমন তারা যখন কোন কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে
বা গরীব-দুঃখীদেরকে সাহায্য করতে পারে, তখন তাদের মধ্যে একটি অন্যরকম আনন্দের অনুভূতি
কাজ করে। এই আনন্দ তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে যা ভালো প্যারেন্টিং এর কারনেই
সম্ভব।
শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষা তাদের অন্যদের সম্পর্কে সুচিন্তা করতে শেখায়। নিজের
স্বার্থ থেকে অন্যের স্বার্থ নিয়ে তারা কাজ করতে পছন্দ করে। অল্প বয়সেই তারা দায়িত্ববোধের
অনুপ্রেরণা পেতে পারে। সমাজে তাদের অনেক দায়িত্ব আছে, সহপাঠী, সহকর্মী ও প্রতিবেশীদের
জন্য তাদের যে কিছু করণীয় আছে, তা তারা বুঝতে পারে তখনি, যখন তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ
জাগ্রত থাকে, যা সম্ভব একমাত্র ভালো প্যারেন্টিং এর মাধ্যমে। পরের কারনে নিজের স্বার্থকে
তারা জলাঞ্জলি দেয়ার শিক্ষা নৈতিক মূল্যবোধ থেকেই পেয়ে থাকে।
প্যারেন্টিং কৌশলে শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা ধর্মীয় আবেগ, অনুভূতি ও চেতনাকে জাগ্রত
করে এবং সকল ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার উদ্রেক করে। যার যার ধর্মমতে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোড়ামী ও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অপসংস্কৃতি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার অনুপ্রেরণা পায়। অতএব, আমাদের যে বিষয়টির প্রতি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে সেটি হলো, শুধুমাত্র বিশ্ব শিশু দিবস পালনের মধ্য দিয়ে শিশুদের অধিকার রক্ষা নয়, বরং শৈশবকাল থেকেই তাদেরকে উন্নত প্যারেন্টিং কৌশলের মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে মানবতার কল্যানে যেন তারা নিজেদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে পরিচিত করতে পারে এমন শিক্ষাই তাদেরকে দিতে হবে। আমাদের শিশুরা যেন সমাজের উৎপাদনশীল সদস্য হয় তা নিশ্চিত করা পিতামাতা,অভিভাবক ও শিক্ষক হিসেবে আমাদের আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই শিশুদের প্যারেন্টিং হোক নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে এবং বিশ্ব শিশু দিবস উদযাপনে এটিই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
Discussion about this post