ড. শফিক আশরাফ
আত্মনির্ভরশীল একটা জাতি গঠনে শিক্ষা অতিপ্রয়োজনীয় একটা কনসেপ্ট। এই শিক্ষা গ্রহণ নানামুখী ও নানা মাত্রায় হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা ইত্যাদি বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একটা নির্দিষ্ট বয়স ও সময় পর্যন্ত এই শিক্ষা গ্রহণ করা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত আছে। কিন্তু এখন প্রশ্নটা হলো, উচ্চশিক্ষা শিক্ষার বিষয়ে পরিকল্পনা প্রসঙ্গে। দেশে ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক লাখ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩২ লাখ তরুণ-তরুণী নানা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বের হচ্ছেন। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম দিকে তিন বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার ডিগ্রির সময়সীমা ছিল। পরে আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিল রেখে চার বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার ডিগ্রি করা হয়। ভাবা হয়েছিল একজন শিক্ষার্থী চার বছরের অনার্স সম্পন্ন করে যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মে তাঁরা নিযুক্ত হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ছোট-বড়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেখানে শিক্ষিত লোকবল প্রয়োজন, সেখানে তারা অনার্স ডিগ্রির পাশাপাশি মাস্টার ডিগ্রির চাহিদা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা শুরু করল। ফলে সেশনজটের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত নিম্নবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করা শুরু করলেন। কিন্তু এই যে মাস্টার ডিগ্রি করা উচ্চশিক্ষিত হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে আমরা তৈরি করছি, সেটা কতটুকু পরিকল্পনাসম্মত সেটা বিবেচনা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ঘোষণা দিয়েছে! কিছুদিন আগে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী রংপুর কারমাইকেল কলেজে এসে এখানে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ঘোষণা দিয়ে গিয়েছেন। দেশে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবে, জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে এটা শুনতে অনেক শ্রুতিমধুর লাগে শুধু তা-ই নয়, শুনে মনে হয় রাতারাতি দেশে একটা শিক্ষা বিপ্লব ঘটে যাবে। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়, এই যে দেশে এখন এত পাবলিক ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাশাপাশি এত কলেজ, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে জ্ঞান দিয়ে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা হচ্ছে, সেটা দেশের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু সম্পর্কযুক্ত বা কতটুকু পরিকল্পনাপ্রসূত সেটা কি নীতিনির্ধারকরা যথাযথ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে বের করেছেন? মনে হয় করেননি! যদি করে থাকতেন, তাহলে যত্রতত্র এত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেত না। দেশে যে হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, তাঁরা প্রতিনিয়ত কাজের জন্য, চাকরির জন্য হাহাকার করছেন, তাঁদের গভীর নিঃশ্বাসে ভারী হতো না দেশের বাতাস। একটা পিয়নের চাকরির জন্য মাস্টার ডিগ্রি পাস করা মানুষকে দরখাস্ত করার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়েও একাধিক পিয়ন, সিকিউরিটি গার্ডকে জানি তাঁরা মাস্টার ডিগ্রি পাস। এটার জন্য দায়ী দেশের সুনির্দিষ্ট শিক্ষা পরিকল্পনার অভাব। দেশে উচ্চশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশনের ক্যাডারভিত্তিক পদগুলো। সেখানে এ বছর ৪৪তম বিসিএসে এক হাজার ৭১০ পদে সার্কুলার হয়েছে। পর্যবেক্ষণযোগ্য হলো, আনুমানিক ৫০ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকারের বিপরীতে এক হাজার ৭১০ পদ! এখানে গভীরভাবে বিবেচনার বিষয় সরকারে প্রথম শ্রেণি পদে প্রতিবছর লোকবল দরকার দুই হাজার আর আমরা বের করছি কয়েক লাখ। এই লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার আমাদের পরিকল্পহীনতার কারণে সৃষ্ট। আবার এই বিসিএস ক্যাডার পদে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কৃষিবিদ, মৎস্যবিশারদ, পুলিশ, অ্যাডমিনের মতো বিভিন্ন পদে চাকরিতে যুক্ত হচ্ছেন। এখন একজন ইঞ্জিনিয়ার বা মৎস্যবিশারদকে তৈরি করতে সরকারকে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ইঞ্জিনিয়ার বা মৎস্যবিশারদ নিজ নিজ কাজে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের কাজে লাগবেন, কিন্তু বিসিএসের মতো উন্মুক্ত সার্কুলারের সুবিধা নিয়ে মৎস্যবিদ হয়ে যাচ্ছেন পুলিশ অফিসার কিংবা অ্যাডমিন অফিসার। আর এর পুরোটাই ঘটে চলেছে শিক্ষা পরিকল্পনার অভাবে। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র শক্তিশালী শিক্ষা পরিকল্পনা কমিশন। সরকার উচ্চশিক্ষার বিষয়ে নানা প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রান্ট কমিশনের (ইউজিসি) ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় গ্রান্ড কমিশন শিক্ষা পরিকল্পনার সক্ষমতা অর্জন করে উঠতে পারেনি। তারাও কোনো গবেষণা বা যথাযথ পরিকল্পনা না করেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভাগ খোলার অনুমতি দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এমনও শোনা গেছে, কোনো উপাচার্য শুধু নিজেদের পছন্দের কোনো প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খুলে বসে আছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের সঙ্গে এর জাস্টিফিকেশন কতটুকু সেটা যেমন ইউজিসি বিবেচনা করেনি, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও করে না। তাহলে কে এটা করবে? অবশ্যই এই দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সরকারকে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে শিক্ষা খাতে অর্থের ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। এখানে একবার ভুল ক্ষেত্রে ভুলভাবে অর্থ ব্যয় মানে রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। সরকার নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারে; কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগে অবশ্যই প্রচুর গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা যেমন বের করতে হবে, তেমনি সেখানে যে বিভাগগুলো খোলা হবে বের করতে হবে তার প্রয়োজনীয়তা, সেখান থেকে বের হওয়া উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কার্যক্ষেত্র, দেশের উন্নয়নে তাদের প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা ছাড়া জনসন্তুষ্টি ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবাধে গড়ে তোলা হয়, সেটা হবে জাতির জন্য ভয়ানক দুর্ভোগের। এমনিতেই উচ্চশিক্ষিত বেকারের চাপ সামলাতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁদের কর্মের ব্যবস্থা করতে পারছে না, সেখানে কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়া আরো বেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে আবার সেখানে বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্র ও বিশ্ব চাহিদা বিবেচনা না করা হয়, তাহলে শুধু যে এর ভার বহন করতে সরকারকে নাকাল হতে হবে তা-ই নয়, অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য জাতি অপূরণীয় অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা থেকে উত্তরণের পথ খুব সহজ হবে না। কারণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন একটা বিভাগ খোলা হয় তখন সেটা রাতারাতি বন্ধ করার কোনো নজির নেই বা বন্ধ করা যায় না! পৃথিবীর অন্য দেশগুলোয় উচ্চশিক্ষার ব্যয় অত্যন্ত বেশি। কারণ তারা মনে করে সবাইকে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কাজেই সেখানে তারা একটা নির্দিষ্ট লেভেল পর্যন্ত হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণ করে কাজে নেমে পড়ে। আর তাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গবেষণা বেইসড। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাও অনেকটা গবেষণাধর্মী। আর আমাদের এখানে ডায়াসবেজ শিক্ষাব্যবস্থায় গবেষণা খুবই অপ্রতুল। ফলে এই গ্লোবাল ভিলেজে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো উদাহরণই তৈরি করতে পারছি না। খুব দ্রুত শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ না করতে পারলে, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বন্ধ না করলে আমরা অন্ধকারে নিমজ্জিত হব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
Discussion about this post