মো. হাবিবুর রহমান
বেগম রোকেয়া বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত ও বাঙালি নারী সাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন হলেও বিয়ের পর তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে আখ্যায়িত হন।
তার রচিত গ্রন্থ যেমন পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর এবং সুলতানার স্বপ্ন প্রকাশের মাধ্যমে নারী সমাজকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। তিনি বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ষষ্ঠ স্থানে নিজেকে অলংকৃত করেছেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার সমসমায়িক নারীদের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারা ও মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন। তিনি ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ অনুচ্ছেদে লিখেছেন, ‘২৫ বছর পূর্বে লিখিত সুলতানার স্বপ্নে বর্ণিত বায়ুযানে স্বপ্নকে সত্যি করতে পেরেছিলাম’। প্রথম মুসলিম অবরোধ-বন্দিনী নারী হিসেবে প্লেনে করে বেগম রোকেয়া আকাশে পরিভ্রমণ করেছিলেন।
১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর বেলা প্রায় ৪ টায় তিনি প্লেনে করে পঞ্চাশ মাইল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি এ বঙ্গের প্রথম মুসলিম পাইলট ও তার বোনের ছেলে মোরাদের বায়ুযানে করে ভ্রমণ করছিলেন। এ প্লেনটি প্রায় ৩ হাজার ফিট উপরে উঠেছিলো এবং ৫০ মাইল উড়েছিলো। উল্লেখ্য যে, তার পূর্বে যে ক’জন মুসলিম নারী উড়োজাহাজ উঠেছিলেন, তারা সাধারণত ইউরোপীয়ান পাইলটের সঙ্গে আকাশ ভ্রমণ করেছিলেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনে দুই জন পুরুষ যথাক্রমে তার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এবং তার স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী তার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের নিজের ঘরেই গোপনে বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।
বেগম রোকেয়ার স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের আগ্রহে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ গল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে পথচলা শুরু করেন। সুতরাং এটা পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, নারীদের প্রতি পুরুষদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তারা একে অপরের পরিপূরক।
জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক করার জন্য উভয়ের প্রতি উভয়ের আন্তরিক ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য রোধ করতে হবে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার জন্যে তার লেখনি, স্কুল ও সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন।
তিনি নারীদের শিক্ষা প্রচারের জন্যে ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি নারীদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী ও পরনির্ভরশীলতা কমানোর জন্যে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে পুরুষের পাশাপাশি বাংলার নারী সমাজ উদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, প্রকৌশলী, ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বিভিন্ন পেশায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরস্থ মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থানে যে ঘরে তিনি থেকেছেন সেটির তিনটি ধ্বংসাবশেষ দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। তার জন্মস্থানকে ঘিরেই নির্মাণ করা হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র।
এ স্মৃতিকেন্দ্রে নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ স্মৃতিকেন্দ্রের সেমিনার কক্ষ, গবেষণা কক্ষ ও গ্রন্থাগার প্রাণবন্ত করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত বেগম রোকেয়ার রচনাবলী সংগ্রহ করলে দর্শনার্থী, পাঠক এবং গবেষকরা উপকৃত হবেন।
এ ছাড়াও এ স্মৃতিকেন্দ্রে বেগম রোকেয়ার রচনাবলী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, আইনি জটিলতার কারণে স্মৃতিকেন্দ্রটি এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে সংস্কৃত মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি এবং বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বিদ্যমান সমস্যা সমাধান সম্ভব।
বেগম রোকেয়ার নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এবং রংপুর অঞ্চলে অনেক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে রংপুরের বাতিঘর হিসেবে খ্যাত রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০০৯ সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর নামে নামকরণ করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীর অধ্যয়নের হার সন্তোষজনক। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নারী সমাজকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদসহ নানান পদে নারীরা কর্মরত আছেন।
প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া পদক নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। যা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। এ বছর বেগম রোকেয়া পদক-২০২১ উপলক্ষে পাঁচজনকে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে অবদান রাখায় মনোনিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ড. জিনাত হুদা। পল্লী উন্নয়নে অবদান রাখায় মনোনিত হয়েছেন কুষ্টিয়া জেলার গবেষক ড. সারিয়া সুলতানা।
এ ছাড়াও আরো মনোনিত হয়েছেন যথাক্রমে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় কুমিল্লার শামসুন্নাহার পরাণ (মরোণোত্তর), নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যশোর জেলার অর্চনা বিশ্বাস এবং নারী শিক্ষায় অবদানের ক্ষেত্রে কুমিল্লা জেলার প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বেলা।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। তার দেহাবশেষ রংপুরে স্থানান্তর করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাকে সমাহিত করা হয় গঙ্গা নদীর তীরবর্তী পানিহাটি গ্রামে। দেহাবশেষ স্থানান্তরের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেননি।
উল্লেখ্য, রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক তার মরদেহ আনার ব্যাপারে ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলায় একাত্মতা ঘোষণা দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও তিনি ২০১০ সালে পায়রাবন্দে দেহাবশেষ আনার বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তর বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন।
তবে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এবং পায়রাবন্দে তার মরদেহ এখনো স্থানান্তর করা হয়নি। সুতরাং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। তাহলে পায়রাবন্দে রোকেয়াপ্রেমীদের দীর্ঘপ্রতীক্ষার অবসান হবে এবং তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
Discussion about this post