কমডোর মীর এরশাদ আলী
স্বাধীনতার রক্তাক্ত ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ধারক এবং বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আত্মপ্রকাশ, বিকাশ ও গৌরবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বহু ঘটনার সাক্ষী ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
১৯৭১-এর এই দিনেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পদ্মা ও পলাশের চরম সাহসিকতা ও অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহিদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দেশের জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঐতিহাসিক ছয় দফায় নৌবাহিনী সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে নেভাল এনসাইন প্রদান করেন এবং একযোগে বানৌজা ঈসা খানসহ তিনটি ঘাঁটি বানৌজা হাজী মহসিন ও বানৌজা তিতুমীর এবং তিনটি জাহাজ কমিশনিং করেন। এ দিনটি আরও মহিমান্বিত হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর বানৌজা সুরমায় প্রথম ও একমাত্র নৌবাহিনীর মহড়া পরিদর্শনের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় যুক্তরাজ্য থেকে সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করা যুদ্ধজাহাজ পরবর্তীকালে ১০ ডিসেম্বর ১৯৭৬ বানৌজা ওমর ফারুক নামে কমিশনিং করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতায় ১৯৭৪ সালে প্রণীত হয় সমুদ্রাঞ্চলবিষয়ক আইন ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট-১৯৭৪’।
সেই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটারের এক বিশাল সমুদ্র এলাকা।
মাত্র দুটি গানবোট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ১৯৭১ সালের নৌবাহিনী বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও দিকনির্দেশনায় আজ একটি ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংযোজিত হয়েছে দুটি আধুনিক সাবমেরিন-বানৌজা নবযাত্রা ও জয়যাত্রা, আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধজাহাজ-ফ্রিগেট, করভেট, লার্জ প্যাট্রল ক্রাফট, ওপিভি, প্যাট্রল ক্রাফট, জরিপ জাহাজ। সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে যুক্ত হয়েছে বিশেষায়িত নৌকমান্ডো দল সোয়াড্স। এ ছাড়া সমুদ্রে জরুরি উদ্ধার ও টহল পরিচালনার জন্য নৌবহরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট ও হেলিকপ্টার সুবিধা সংবলিত নেভাল এভিয়েশন। পাশাপাশি চলমান রয়েছে আধুনিক সারভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট সংযোজন ও কমব্যাট সিস্টেমগুলোর আধুনিকায়নের কার্যক্রম। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক প্রশিক্ষণ সুবিধা সংবলিত নতুন নতুন অবকাঠামো ও স্থাপনা।
নৌবাহিনীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড, যার মাধ্যমে দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের এ বিশাল জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ সমুদ্রসম্পদের নিরাপত্তা ও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান এবং দেশের জলসীমায় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়। এ ছাড়া জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী ‘জাতীয় মৎস্য পদকে’ ভূষিত হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধারণ করে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সাহস, বীরত্ব, অসামান্য পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার মাধ্যমে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় মিয়ানমারের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের বসবাসের জন্য নৌবাহিনী ভাসানচরে মানসম্মত আবাসন তৈরি করেছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত, জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুস্থ ও অসহায় মানুষের মানবিক সহায়তা, জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করেছে নৌবাহিনী। দেশের মানুষের সেবায় লোকচক্ষুর অন্তরালে গভীর সমুদ্রে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। দেশের যে কোনো প্রাকৃতিক ও নৌদুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযান ও মানবিক সহায়তা প্রদান করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এ বিশেষ সময়ে নৌবাহিনী ১০ ডিসেম্বর ‘নেভাল এনসাইন ১০-স্মৃতিতে অম্লান বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী র্যালি, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, অসহায়দের মাঝে মানবিক সহায়তা প্রদান ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’-এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে বাংলাদেশের জলসীমার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বিশাল এ সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালনে সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ।
কমডোর মীর এরশাদ আলী, (জি), ওএসপি, এনপিপি, এনডিসি, পিএসসি, বিএন : পরিচালক হিসাবে নৌবাহিনী সদর দপ্তরে কর্মরত
Discussion about this post