জাকির হোসেন জুমন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুল কতটা নিভৃতচারী ও আত্মপ্রত্যয়ী নারী, এর প্রমাণ আরেকবার পেয়েছিলাম স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনে গিয়ে। প্রথম দিন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে গিয়ে দেখতে পেলাম, ভেতরের কক্ষে অনেক লোকের আনাগোনা। একজন বললেন, পুতুল আপা এখানে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছেন। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে মিটিংয়ের সময় অনেকের আনাগোনা স্বাভাবিক মনে হলেও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বিষয়টি দৃষ্টিকটু। কিন্তু পুতুল আপা তার স্বভাবগত ভদ্রতার কারণে কাউকে কিছু বলতে পারছিলেন না। আমি দ্রুত মিটিংরুমে ঢুকলাম এবং পুতুল আপার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো যে মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কেউ রুমে ঢুকতে পারবে না।
ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা বিকেল ৪টায়। সামনে দাঁড়ানো দু’জন বিদেশি ভদ্রলোক, সঙ্গে টিভি ক্যামেরা। আমাকে জানালেন, পুতুল আপার সঙ্গে তাদের পূর্বনির্ধারিত শিডিউল রয়েছে। তিনি ততক্ষণে মিটিংয়ের শেষ প্রান্তে। আমাকে জানালেন, ১০ মিনিটের একটি ছোট ব্রেক শেষে সাক্ষাৎকার দেবেন, মিটিংরুমেই। ১০ মিনিট পরে সাংবাদিক আর ক্যামেরা ক্রুদের ভেতরে নিয়ে এলাম। সবকিছু ঠিক করে সাক্ষাৎকার শুরু হলো। কোনো প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয়বার চিন্তা করে দিতে হয়নি পুতুল আপাকে। তার আত্মবিশ্বাস এমন ছিল যে নিজের কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন তার চোখের মধ্যে ফুটে উঠেছিল নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদের কথা। মনে হচ্ছিল, তিনি বিশ্বের প্রতিটি বাস্তুচ্যুত মানুষের এক একটি কষ্টের গল্প তুলে ধরছেন। সাক্ষাৎকার শেষ হলো বিকেল ৫টা নাগাদ। জানতে চাইলাম, দুপুরের খাবার খেয়েছেন কিনা। বললেন, সময় পাননি।
আমি কিছু খাবার নিয়ে আসতে চাইলে পুতুল আপা বললেন, তিনি একটু হাঁটতে চান। সেই সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস খাওয়া যেতে পারে। বাইরে তখনও অনেকে সাক্ষাৎপ্রার্থী। পুতুল আপা বের হয়ে সবার সঙ্গে ধৈর্য সহকারে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বললেন। তারপর আমি আর পুতুল আপা হাঁটা শুরু করলাম। সামান্য দূরত্বে পেছন থেকে পুতুল আপাকে দৃষ্টির সীমানায় রাখছেন দু’জন এসএসএফ সদস্য। যদিও পুতুল আপা খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা থাকেন, তারাও বিষয়টি মেনে নিয়ে স্বাভাবিক চলার পথ থেকে একটু দূরত্বে অবস্থান করেন।
আমরা কফিশপে গিয়ে কফি নিলাম, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম অনেক সময়। তারপর তিনি রওনা হলেন তার হোটেলের উদ্দেশে।
দ্বিতীয় দিন সকালবেলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মসূচি ছিল স্কটল্যান্ড প্যাভিলিয়নে। আমরা সবাই গিয়ে ওইখানে উপস্থিত হলাম। অনুষ্ঠান শুরুর একটু পর গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন পুতুল আপা। তাকে সামনের সারিতে একটি চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা করলেন স্কটল্যান্ড প্যাভিলিয়নের কর্মকর্তারা। তিনি মনোযোগ সহকারে পুরো মিটিংয়ে সবার বক্তব্য শুনলেন। অনুষ্ঠান শেষ হতেই অন্যান্য মিটিংয়ে যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী পরিদর্শন করলেন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন।
এরই মধ্যে কেউ একজন পুতুল আপাকে কয়েকটি বই দিতে চাইলে তিনি আমাকে ডেকে বললেন, বইগুলো আমার কাছে রাখতে এবং যাওয়ার সময় যাতে মনে করে বইগুলো তাকে দিই। তারপর তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর জানতে চাইলাম, আমি থাকব কিনা; তিনি বললেন থাকার জন্য।
বাংলাদেশ হাইকমিশন যুক্তরাজ্যের একজন কর্মকর্তা আর এসএসএফের একজন কর্মকর্তা পুতুল আপাকে সার্বক্ষণিক অনুসরণ করে পেছনে পেছনে হাঁটছেন। যথারীতি ১০-১৫ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে।
এক এক করে পুতুল আপার সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলাম। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, তা আমাকে বিস্মিত করেছে। সবাই হাসিমুখে প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাকে স্বাগত জানালেন। দেখলাম প্রিন্স চার্লস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, বিল গেটস, জন ক্যারিসহ বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে তার যে পরিচয় ও সম্পর্ক তা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
কয়েকটি অনুষ্ঠান শেষ করতেই ঘড়িতে প্রায় ২টা বেজে গেছে। পুতুল আপা আমাকে বললেন, তার একজন বন্ধু এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সহযোগী কর্মকর্তা তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। যদি সম্ভব হয় তাহলে খুঁজে বের করতে। যদি সম্ভব হয় বলার কারণ হলো- এই সম্মেলনস্থলের জায়গা এত বিশাল যে কেউ যদি হাঁটতে থাকে তাহলে খুঁজে বের করা কঠিন। একসঙ্গে প্রতিদিন ৩৮০০০ লোক হেঁটে প্রবেশ করেন সম্মেলনস্থলে। বিশাল এলাকায় কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন বিধায় পুতুল আপা তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, তার অবস্থান কোথায় এবং সেই প্যাভিলিয়নের উদ্দেশে রওনা হলেন। আমার সঙ্গে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, তিনি আর হাঁটতে পারবেন না, কারণ সকাল থেকে একসঙ্গে কয়েক কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে। এদিকে দুপুরের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে; পরে আবার তার মিটিং আছে। কিন্তু আমরা অনেক খুঁজে কোথাও বসার জায়গা পেলাম না। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই।
হঠাৎ দেখলাম, একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা একটা চেয়ারে বসে আছেন এবং চারদিকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে চেয়ারটা দিলেন। আমি পুতুল আপাকে বসতে বললাম এবং রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে প্রায় ৪০ মিনিট দাঁড়ানোর পর আমি কাউন্টারে এসে খাবার অর্ডার করলাম। পুতুল আপা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন আমি যেন তার জন্য মাছ বা সবজি জাতীয় খাবার নিয়ে আসি।
আমি খাবার নিয়ে এলাম এবং এরপর যা হলো তা অবিশ্বাস্য। পুতুল আপা চেয়ার থেকে উঠে আমাকে বললেন, তুমি অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলে, এখন তুমি একটু বসো। হতবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে আর বললাম- আপা, দয়া করে আপনি বসেন। তারপর আমরা খাবার খেলাম। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কেউ কাছে আসছেন না; কিন্তু দূরে থেকে আমাকে বারবার বললেন যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পুতুল আপার পরের মিটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। পুতুল আপা বললেন, সময় নেই, তবে খাবার নষ্ট করা যাবে না। আমরা একটি ব্যাগে করে খাবারগুলো নিলাম।
পরবর্তী মিটিংয়ে যেতে যেতে আমাকে বললেন- তার বন্ধুর সঙ্গে কয়েকটি ছবি উঠাবেন, আমি যেন মিটিং শেষে ছবিগুলো উঠিয়ে দিই। তার কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগটি ছিল, আমি অনেকবার অনুরোধ করে বললাম, ব্যাগটি আমার কাছে দেওয়ার জন্য। তিনি বললেন, আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি, তা ছাড়া আমার ব্যাকপ্যাক তুমি কাঁধে নেবে এটা দৃষ্টিকটু দেখায়।
আরও অনেক বিষয়ে আলাপ করলেন, বাচ্চাদের খবর নিলেন, এলাকার খবর নিলেন, দেশকে নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বললেন। বিশেষ করে তার জীবনের বিভিন্ন শিক্ষণীয় জিনিস আমাকে জানালেন। আমিও অভিভূত হয়েছি এবং শিখেছি অনেক।
সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাকে আবেগতাড়িত করেছে সেটা হলো, একজন বাঙালি নারী হয়ে কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে আজকের এই জায়গায় আসতে। সেই যাত্রাপথ কতটা কণ্টকপূর্ণ ছিল, তা আমাকে বোঝালেন। তবে যে বিষয়টি তিনি কথা বলতে চাননি তা হলো রাজনীতিতে তার আগ্রহ বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়। মিটিং শেষে তার ছবি তুলে দিলাম এবং তার একটু পরেই আমি বহির্গমন গেট পর্যন্ত হেঁটে বিদায় জানালাম এবং তিনি চলে গেলেন হোটেলের উদ্দেশে।
তৃতীয় দিন সকালবেলা সম্মেলন ভেন্যুতে আসতে আমাদের একটু দেরি হয়েছে, যেহেতু মন্ত্রীরা গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানাতে। উপস্থিত হয়ে দেখলাম, পুতুল আপা ইতোমধ্যেই এসে একটি মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। আমি ওই মিটিংরুমে ঢুকতেই তিনি মঞ্চ থেকে মৃদু হেসে আমার উদ্দেশে হালকা হাত নাড়েন। আমি একটু পরই সামনে এগিয়ে গিয়ে তার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি নিলাম।
মিটিং শেষ করে পুতুল আপা আরও কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিলেন এবং তার বিনম্র কথার মাধ্যমে জ্ঞানগর্ভ শব্দচয়নে সাংবাদিকবৃন্দ উদ্বেলিত হয়েছেন। পাশে বসে প্রতিটি সাক্ষাৎকার যখন শুনেছি, তখন নিজে নিজেই হিসাব কষে নিয়েছি যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এমনই হয়, যার ভাবনা বা পরিকল্পনা শুনলে মনে হয় বিশ্বনেতৃত্বের ভবিষ্যৎ অংশীদার। তিনি যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম দেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কাণ্ডারি। তার কন্যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব নেতৃত্বের সব গুণ।
আজ পুতুল আপার জন্মদিন। কামনা করি, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ তাকে জানার সুযোগ যেন পায়। শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধেয় সায়মা ওয়াজেদ। আমাদের প্রিয় পুতুল আপা।
লেখক- জাকির হোসেন জুমন ,তরুণ উদ্যোক্তা ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
Discussion about this post