অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান
পঞ্চাশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের উপাখ্যান এক কথায় অসামান্য। একেবারে শূন্য হাতে শুরু করে অদম্য বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছেছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া মোটেও সহজ নয়। তবে এর পেছনে আশাবাদী নেতৃত্বের জোর ভূমিকার কথা মানতেই হবে। আর নেতৃত্বের কথা বলতে গেলেই সবাইকে ছাপিয়ে উঠে আসেন বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজনৈতিক অঙ্গনে তার জীবনভর নিরন্তর লেগে থাকা, জনগণের প্রতি তার ‘অক্ষয় ভালোবাসা’ এবং ‘করে করে শেখার’ যে অদম্য বাসনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সেটিই ছিল জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মূল শক্তি। সর্বক্ষণ ভেবেছেন কী করলে জনগণের মধ্যে লড়াকু এক মনের সঞ্চার করা যায়। আর সেই ভাবনাকে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়ানের উদ্যোগ নিয়েছেন। তার এই উদ্যোগী ভূমিকার সন্ধান পাই আমরা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পরিচালনা, ছেষট্টির ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও তার প্রচারণায়, জেলে বসেও জাতিকে সাহস ও দিশা দেওয়া এবং প্রাদেশিক মন্ত্রী হিসেবে পূর্ব বাংলার কৃষক ও উঠতি শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করার মতো নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাঝে।
তিনি কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তার ইঙ্গিত রেখে গেছেন তার ভাষণে, ডায়েরিতে, সংবিধানে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে এবং বিশেষ করে তার দ্বিতীয় বিপ্লবের রূপরেখায়। দুর্নীতিমুক্ত সামাজিক দায়বদ্ধ সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তিনি তার প্রতিটি কথায়, নীতিতে এবং দলিলে রেখে গেছেন। একই সঙ্গে মাত্র সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনায় তিনি হাতে-কলমে দেখিয়ে গেছেন কী করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোতে হয়। জাতির দুর্ভাগ্য তার সেই নান্দনিক নেতৃত্বের স্পর্শ বিশ্বাসঘাতকের দল খুব বেশিদিন তাকে পেতে দেয়নি। তবে তার স্বপ্ন ও কর্মের রূপরেখাকে সম্বল করেই এগিয়ে চলেছে আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে ‘শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির’ দেশে পরিণত করতে চান। ঐ দিনই বিকেলে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই তিনি রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন যে, সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ করবেন। যে কথা সেই কাজ। কালমাত্র বিলম্ব না করে তিনি নেমে পড়েছিলেন বাংলাদেশের সব মানুষের উন্নয়নের এক অসামান্য অভিযাত্রায়।
আছে দুঃখ। আছে কষ্ট। আছে সীমাহীন অপ্রাপ্তি। তবুও বুকে সব কষ্ট চেপে স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সীমানায়। মাঝখানে বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে নেমে এসেছিল চরম হতাশা, বিভাজন ও স্বাধীনতা-বিরোধী অপচেষ্টা। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে ফের বাংলাদেশ ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পথরেখায়। এখনো আছে অন্যায়, অনাচার, অধিকার ও দুর্নীতি। কিন্তু শরতের কালো মেঘের পাশাপাশি রয়েছে কাশবনের উপরিভাগের মতো অনেক সাদা মেঘ।
আজকের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ঐসব কালো মেঘকে সুনীতি ও সুকর্ম দিয়ে কি করে ঢেকে ফেলা যায়। বাংলাদেশের ‘ডিএনএ’-এর মধ্যে আছে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মুক্তির জন্য লড়াই করে এগিয়ে চলার বাসনা। আর সেই সামাজিক পুঁজিকে সম্বল করেই এগিয়ে চলেছে দুর্বার বাংলাদেশ। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ অনেক শিখেছে করে করে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে ‘শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির’ দেশে পরিণত করতে চান। ঐ দিনই বিকেলে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই তিনি রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন যে, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে তিনি যদি সব মানুষকে খাদ্য দিতে না পারেন, তরুণদের কর্মসংস্থান না করতে পারেন। আর বলেছিলেন যে, সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ করবেন। যে কথা সেই কাজ। কালমাত্র বিলম্ব না করে তিনি নেমে পড়েছিলেন বাংলাদেশের সব মানুষের উন্নয়নের এক অসামান্য অভিযাত্রায়।
ছিল না প্রতিষ্ঠান। ছিল না কেন্দ্রীয় সরকার। ছিল না এক ডলারও রিজার্ভে। ছিল না আইনকানুনের তেমন কোনো ভিত্তি। এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সহনেতার সঙ্গে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি অসাধ্য সাধন করেছিলেন। পর্যবেক্ষকদের সকল তাচ্ছিল্য ও হতাশাজনক ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণ করে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘মেঠোপথ’ থেকে ‘মহাসড়কে’ যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিপুল খাদ্য ঘাটতি, দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক বিশেষ মহলের খাদ্য সাহায্য কেন্দ্রিক নষ্ট কূটনীতি এবং অস্থির ও বিভাজনের রাজনীতি মোকাবিলা করেই তিনি বাংলাদেশকে এক সুস্থিতির পথে নিয়ে এসেছিলেন।
বাহাত্তরের তিরানব্বই ডলারের মাথাপিছু আয়কে তিনি পঁচাত্তরেই ২৭৩ ডলারে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। কৃষি ও শিল্প দুই পায়ে ভর করেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় নির্মাণসহ কত কিছুই না তিনি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলেন। শিল্পের রাষ্ট্রীয়করণ চলমান বাস্তবতায় অবধারিত ছিল। তবুও তিনি শেষ দিকে ব্যক্তিখাতের প্রসারের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ এশিয়ায় এক নম্বর দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এদেশের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। আট মাসের সমান তার রিজার্ভ। দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশের আশেপাশেই। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়লেও ভোগ্য বৈষম্য অনেকটাই স্থিতিশীল।
পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাও সামাজিক দায়িত্ববোধ বজায় রেখেও বাজার অর্থনীতির বিকাশে মনোযোগী হন। বঙ্গবন্ধুর মতোই কৃষিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে এই খাতকে আধুনিক ও বহুমুখী করে চলেছেন। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রসারে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মেগা প্রকল্প ছাড়াও গ্রাম-পর্যায়ে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন। এমন কি সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করে চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছেন। আর সে কারণেই করোনা মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বর্তমানে সাত শতাংশের বেশি হার প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ এশিয়ায় এক নম্বর দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এদেশের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। আট মাসের সমান তার রিজার্ভ। দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশের আশেপাশেই। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়লেও ভোগ্য বৈষম্য অনেকটাই স্থিতিশীল।
পদ্মাসেতুসহ মেগা প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হওয়ার পথে। তাই আগামীতে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত বাংলাদেশ এখন উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চাইছে। এরপর তার লক্ষ্য উন্নত দেশ হওয়ার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ বিশ্ব সেরা। যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনৈতিকতা এবং সামাজিক অশান্তি নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়ন অভিযাত্রা অক্ষুণ্ন রাখা যায় তাহলে বাংলাদেশ নিশ্চয় তার আগামীর স্বপপূরণ করতে সক্ষম হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই আমাদের নিচের নীতি উদ্যোগগুলো নিষ্ঠার সাথে পূরণ করতে হবে—
০১) ভোগ স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বজায় রাখার চলমান স্বদেশি উন্নয়ন কৌশল অব্যাহত রাখতে হবে।
০২) শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার উপর আরও জোর দিয়ে মানুষের উপর বাড়তি বিনিয়োগ করে যেতে হবে।
০৩) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, বড় মাপের ডাটা ব্যবস্থাপনার জন্য মানবপুঁজির দক্ষতা অর্জনে বিশেষ মনোযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
০৪) বর্তমান রপ্তানি খাতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেই অন্যান্য সম্ভাব্য রপ্তানি খাতে বাজেট ও মুদ্রানীতির সমর্থন বাড়াতে হবে।
০৫) পর্যটন ও বিনোদন শিল্পের বিকাশে সমর্থন বাড়াতে হবে।
০৬) খাদ্য-প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে আরও সমর্থনের অংশ হিসেবে এসএমই ও বিদেশি বিনিয়োগের উপর সমর্থন আরও বাড়াতে হবে।
০৭) তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে আমাদের দ্বিতীয় ‘পোশাক শিল্পে’ পরিণত করতে হবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদে ও মাঝারি ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের বাড়তি প্রণোদনা দিতে হবে।
০৮) টেকসই সবুজ নগরায়নে মনোযোগ দিতে হবে। রাজশাহীর মতো সবুজ নগরী গড়ে তুলতে হবে।
০৯) আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বাংলাদেশকে দ্রুত সংযুক্ত করতে হবে।
১০) কর-জিডিপি অনুপাত দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
১১) স্বদেশি শিল্পায়নকে মদদ দিয়ে জলবায়ু সহায়ক ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানকে কার্যকর করা জরুরি।
অতীতে ধাপে ধাপে খাপ খাওয়ানো নীতি গ্রহণের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আগামী দিনেও রাষ্ট্র, বাজার ও সমাজকে একই সুতোয় বেঁধে আমাদের রূপান্তরবাদী নীতি গ্রহণের সংস্কৃতিকে আরও জোরদার করে যেতে হবে। তাহলেই সোনার বাংলা নির্মাণের লক্ষ্য আমাদের পূর্ণ হবে।
লেখক- ড. আতিউর রহমান , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ।
Discussion about this post