কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি ‘অপারেশন সার্চ লাইটে’র মাধ্যমে গণহত্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈনিকরা। শুরু হয় বিদ্রোহ, তারা রুখে দাঁড়ান হানাদারদের বিরুদ্ধে। হানাদারদের অসংখ্য সদস্য নিহত হতে থাকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ আক্রমণে। এমতাবস্থায় সামরিক নেতৃত্ব বুঝতে পারে, হানাদারদের যথাসম্ভব দ্রুত পরাজিত করার জন্য গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি নিয়মিত বা প্রচলিত যুদ্ধও শুরু করতে হবে; যেজন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত ব্রিগেডের। সে আলোকে তিনজন সিনিয়র সেক্টর কমান্ডার-লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল সফিউল্লাহ ও লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে তাদের নামের আদ্যাক্ষর ‘জেড’, ‘এস’ ও ‘কে’ নামে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার লক্ষ্যে ২৩ আগস্ট ২নং সেক্টরের অধীনে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম, ১০ম ব্যাটালিয়ন এবং ৩নং সেক্টরের অধীনে ১১তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার থেকে আদেশ জারি হয়, যা ছিল বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে যুগান্তকারী এক ঘটনা। কারণ যুদ্ধকালীন প্রথাগতভাবে কোনো ফাইটিং ইউনিট গঠন করার ঘটনা খুবই বিরল। তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার জন্য এ তিনটি পদাতিক ইউনিট গঠন করার উদ্যোগ মেধাবী সামরিক অধিনায়কদের ব্রেইনচাইল্ড। এর মাধ্যমে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনা সহজ হয়ে যায় এবং মুক্তিযুদ্ধ এক আলাদা গতি লাভ করে।
৯ম ইস্টবেঙ্গলের প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের একটি অংশ হলো নবম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর নিক নেইম ‘চার্জিং নাইন’। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ‘চার্জিং নাইন’ ঐতিহ্যবাহী ইউনিটগুলোর অন্যতম; যেটি ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের ময়দানে জন্মলাভ করেছিল। নবগঠিত ইউনিট হিসাবে চার্জিং নাইন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা ও সফলতার মাধ্যমে বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
হৃদয়বিদারক ঘটনা : স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আদেশ জারি হয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে এ ইউনিট গঠনের পর্যায়ে ছিল। এ জন্য রিক্রুটরাও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) প্রশিক্ষণরত ছিল। নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মার্চের প্রথমদিকে ইউনিটের অধিনায়ক হিসাবে ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে মেজর আবু ইউসুফ মুশতাক আহমদ এবং অ্যাডজুটেন্ট হিসাবে ৪ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনকে (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) বদলির আদেশ জারি করা হয়। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা এবং বাঙালি-পাকিস্তানিদের সম্পর্ক ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে। অধিনায়ক মেজর মুশতাক গমনাদেশ নিয়ে নতুন ইউনিটে যোগদানের উদ্দেশ্যে ২৩ মার্চ সেনাসদরে ব্রিফিং নিতে গেলে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নির্মমভাবে শহিদ হন। জানা যায়, পাকিস্তানি অফিসাররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালিদের সমন্বয়ে গঠিত দি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে কটূক্তি করলে মেজর মুশতাক দৃঢ় প্রতিবাদ করেন এবং অপমানজনক মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে জোর দাবি জানান। প্রতিবাদী ও দেশপ্রেমে বলীয়ান একটি কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতেই এই মেধাবী সেনা অফিসারকে অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চের সেই অভিশপ্ত রাতে হানাদার বাহিনী ৯ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণরত রিক্রুটসহ ইবিআরসির সব রিক্রুটকে ঘুম থেকে উঠিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।
কুমিল্লা সেনানিবাসের ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে বদলি হয়ে ৯ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদানকালীন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন উপরোক্ত ঘটনায় খুবই মর্মাহত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন। ৯ম ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ও রিক্রুটদের নৃশংস মৃত্যুতে তিনি আর চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা না করে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে আবার চলে যান ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে। তার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই তখনকার মতো যবনিকাপাত ঘটে ৯ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কর্মকাণ্ড।
যুদ্ধক্ষেত্রে অবদান : প্রতিষ্ঠা লাভের পরপরই শত্রুদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত কসবা দখলের যুদ্ধের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ‘কে’ ফোর্সের ব্যাটালিয়ন ৯ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের; যার কমান্ডে ছিলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল)। অপারেশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিধায় বিখ্যাত কসবা রণাঙ্গনে খালেদ মোশাররফ সরাসরি এ ইউনিটকে সহযোগিতা করেন। তার উপস্থিতিতে সৈনিকরা দারুণ উজ্জীবিত হয়। এ যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তিনজন অফিসার ও ৪০ জন সেনা ও মুক্তিযোদ্ধা শাহাদতবরণ করেন, আহত হন ৬০ জন।
অতঃপর লেফটেন্যান্ট এম হারুন-অর-রশীদের নেতৃত্বে ৯ম ইস্টবেঙ্গল চন্দ্রপুর ও লাকুমুড়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ২১ নভেম্বর। এ যুদ্ধে একজন অফিসার এবং তিনজন প্লাটুন কমান্ডারসহ ৩১ জন সৈনিক শাহাদতবরণ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯ পাঞ্জাবের একজন শিখ মেজরসহ ১২ জন নিহত এবং প্রায় ৩০ জন আহত হন। যদিও শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে আক্রমণ প্রত্যাহার করতে হয়েছিল, তথাপি অপারেশনটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। ১১ ও ১২ নভেম্বর কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি দখলের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের কুমিল্লার দিকে আরও পিছু হটিয়ে দেয়। দুই দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ১৪ জন নিহত ৪০৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুজন শহিদ ও একজন আহত হন। ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার উত্তর এলাকা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ৯ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ার বাজার এলাকায় সমাবেশ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ২ ডিসেম্বর ৯ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে মিয়ার বাজারের দিকে অগ্রসর হয়।
মিরপুর মুক্তকরণ : ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ শেষ হলেও মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বসবাসরত বিহারি সম্প্রদায়ের লোকজন ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা প্রদান করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তাদের এলাকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়াতে থাকে। ৯ম ইস্টবেঙ্গলকে মিরপুর ৬, ১০ ও ১১ সেকশন ঘেরাও করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইউনিটের প্রধান কাজ ছিল বিহারিদের নিরস্ত্রীকরণ এবং দখলদার বাহিনীর দোসরদের হাতে নিখোঁজ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করা। এ সময় মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী বীর উত্তম নতুন অধিনায়ক হিসাবে ৯ম ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেন। ৯ম ইস্টবেঙ্গলের সার্বিক প্রচেষ্টায় প্রায় তিন সপ্তাহ পর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে মিরপুর এলাকা মুক্ত হয়। বিহারিদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত হয়।
১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেকটি দুর্ধর্ষ ও ঐতিহ্যবাহী ব্যাটালিয়ন হলো ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর পরিচিতি নামও ‘দুর্ধর্ষ দশ’। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ ইউনিট ব্যাপক অবদান রাখে। যুদ্ধের আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনেই ঢাকায় এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, যা ছিল মূলত ক্যাডেট প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়ন। জাতীয় প্রতিরক্ষা স্কিমের আওতায় যুদ্ধকালীন প্রয়োজনে দ্বিতীয় পর্যায়ের সৈনিক হিসাবে স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের এই রেজিমেন্ট সামরিক প্রশিক্ষণ দানে নিয়োজিত ছিল। প্রশিক্ষক ছাড়া সেনাবাহিনীর নিয়মিত কোনো সৈন্য এই রেজিমেন্টে নিয়োগ করা হতো না; যাদের ৫০ শতাংশ ছিলেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে, আর বাকি ৫০ শতাংশ পাঞ্জাব, বালুচ ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট থেকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধকে আরও বেগবান করার জন্য প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার থেকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম, ১০ম ও ১১তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ জারি করে। এ চিঠি অনুযায়ী ২নং সেক্টরের অধীনে ৯ম ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে স্থগিত ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আগের সদস্যরা ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ একীভূত করে ৭৫০ জনেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা সদস্যের সমন্বয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ পুনর্গঠিত ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসাবে নিয়োগ করা হয় রাজনগর সাব-সেক্টরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জাফর ইমাম বীর বিক্রমকে। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন বিলোনিয়ার সুয়ার বাজারের বিপরীতে ভারতের রাজনগর সাব-সেক্টরে ব্যাটালিয়ন সদর দফতর স্থাপন করা হয়।
এদিকে রাঙ্গামুড়া সাব-সেক্টরের সব সৈন্য নিয়ে ১০ম ইস্টবেঙ্গলের আলফা (এ) কোম্পানি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান বীর বিক্রমকে (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল)। সেই মোতাবেক অক্টোবরের শেষদিকে রাঙ্গামুড়া ক্যাম্পটি সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে দিয়ে ‘এ’ কোম্পানি গঠন করা হয়।
এরপর নবগঠিত ব্যাটালিয়নটির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, যে কোনো মূল্যে বিলোনিয়া এলাকাটি পুনর্দখল করা। কারণ, ফেনী জেলার সীমান্তসংলগ্ন বিলোনিয়া পকেটটি অনেক বড় এবং যুদ্ধের সময় সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘কে ফোর্স’ গঠনের পর ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর জাফর ইমামকে বিলোনিয়া অপারেশন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ইউনিটের ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ যুদ্ধে ১০ম ইস্টবেঙ্গল দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে এবং শত্রুকে পরাজিত করে অসাধারণ বিজয় অর্জন করে এবং মুক্ত হয় বিলোনিয়া। এটি ছিল একটি অসাধারণ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অতি সফল ও সার্থক একটি অভিযান হিসাবে এটি ইতিহাসের পাতায় চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। বিশ্বের যুদ্ধাতিহাস ও সামরিক মানদণ্ডে বিলোনিয়া যুদ্ধ এক ব্যতিক্রমী বীরত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এ যুদ্ধে শত্রুর বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় বহু অফিসার ও সৈনিক। বেঁচে যায় কেবল দুজন অফিসার ও ৭২ জন সৈনিক, যারা আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য অনেকেই বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত হন। এরপর ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আরও অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক (বিভিন্ন পদবির) শাহাদতবরণ করেন ও অনেকেই আহত হন। নয়জন ‘বীর বিক্রম’ ও চারজন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে ১১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও অবদান : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধকে আরও বেগবান ও ত্বরান্বিত করার জন্য প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম, ১০ম ও ১১তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ জারি করে। এ চিঠি অনুযায়ী ৩নং সেক্টরের অধীনে ১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ চিঠির আলোকে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ফটিকছড়াতে ১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ঐতিহ্যবাহী নাম ‘দুর্নিবার এগারো’।
এই ব্যাটালিয়ন ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের আখাউড়া, তেলিয়াপাড়া, ধর্মনগর, মনতলা এলাকায় বিভিন্ন সামরিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। দুর্নিবার এগারো ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই এলাকাগুলো শত্রুমুক্ত করে। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার হারিসপুর-শাহবাজপুর অক্ষ অনুসরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে রওনা হয়। ব্যাটালিয়নের অগ্রগামী দল তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্গত চান্দুরা এলাকায় পৌঁছার পর ইসলামপুরে অবস্থানরত ব্যাটালিয়ন সদর শত্রুর আকস্মিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এতে ব্যাটালিয়নের চারজন সৈনিক (দুইজন ভারতীয় অপারেটরসহ) শহিদ হন এবং অধিনায়ক মেজর আবু সালেহ মুহাম্মদ নাসিমসহ ছয়জন সৈনিক গুরুতর আহত হন (সর্বমোট আহতের সংখ্যা ১১)।
‘এস ফোর্সের’ অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : ‘এস ফোর্স’ কমান্ডার লে. কর্নেল সফিউল্লাহ ২য় ইস্টবেঙ্গল ও নবপ্রতিষ্ঠিত ১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে সমন্বিত করে নিয়মিত ব্রিগেড হিসাবে ‘এস ফোর্স’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ফোর্স গঠনে ওই দুই ব্যাটালিয়নের সৈন্য সংখ্যার ঘাটতি পূরণে সেক্টর ট্রুপস থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। ১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে মুকুন্দপুর ও হরমুজপুর এলাকায় নিয়োজিত করা হয়। এস ফোর্সের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল ও আশুগঞ্জ থানা ও হবিগঞ্জ মহকুমা। কিন্তু নভেম্বরের শেষদিকে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে এস ফোর্স ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার আশুগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব হয়ে নরসিংদী মহকুমার রায়পুরা-নরসিংদী দখলপূর্বক নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জ হয়ে তারাব ও ডেমরা এলাকা দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। এস ফোর্সের উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলো ছিল ধর্মগড় এলাকায় মর্টার আক্রমণ, মনোহরদী অবরোধ, কলাছড়া চা বাগান অপারেশন, বামুটিয়া এলাকায় আক্রমণ, আশুগঞ্জে মেঘনা ব্রিজ ধ্বংস ইত্যাদি। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ সাহসীকতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনজন ‘বীর বিক্রম’, আটজন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন।
অধিনায়ক মেজর নাসিমের যুদ্ধে আহত হওয়ার ঘটনা : ৬ ডিসেম্বর ব্যাটালিয়ন পর্যবেক্ষক দল ইসলামপুরে অবস্থান করছিল। তখন সেখানে ব্যাটালিয়ন পর্যবেক্ষক দলে এস ফোর্স কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ, অধিনায়ক মেজর নাসিমসহ মাত্র আটজন সৈনিক অবস্থান করছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত ব্যাপক আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্রমশ পিছু হটছিল। পাকিস্তানিদের গাড়িকে লে. কর্নেল সফিউল্লাহ নিজেদের গাড়ি মনে করে ভুল করলেন। গাড়ি থামালে দেখা গেল গাড়িতে পাকিস্তানি সেনা। লে. কর্নেল সফিউল্লাহ সবাইকে হাত উঠাতে বললে কেউ কেউ হাত উঠাল। গাড়ির সামনে বসা পাঠান সুবেদার লাফ দিয়ে লে. কর্নেল সফিউল্লাহকে ধরে ফেলে। এ সুযোগে পাকিস্তানি সেনারা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গুলি চালানো শুরু করে। লে. কর্নেল সফিউল্লাহর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর পেছনের দল ছিল বেশ পেছনে। অপরদিকে সামনের দলও বেশ এগিয়ে গেছে। ঘটনার শেষপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর পেছনের দলটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। উভয়পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গুলিবিনিময় হয়। শেষ পর্যন্ত লে. কর্নেল সফিউল্লাহ, মেজর নাসিম প্রাণে বেঁচে যান। এ সংঘর্ষে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। পাকিস্তানিদের ১১ জনকে জীবিত ধরা হয়। এরপর ৭ ডিসেম্বর মেজর মতিনকে ১১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আলোচিত এ তিনটি ইউনিটের অসাধারণ অবদান আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে করেছে বহুগুণে গৌরবান্বিত।
লেখক- কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাসবিদ
Discussion about this post