ড. আনোয়ারা আলম
আরেক নক্ষত্রের পতন। বেগম মুশতারী শফী – এক সংগ্রামী চেতনা –এক অগ্নিশিখা—এক বিদ্রোহ সত্তার অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। জীবন যে কতবড় এবং তাকে যে সাধনায়, ত্যাগে, সদিচ্ছায়, শ্রমে অঙ্গীকারে কত সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে নির্মাণ করা যায় –তার দৃষ্টান্ত বেগম মুশতারী শফী। অশুভ, অসুন্দর, অকল্যাণ এর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন সক্রিয় এক যোদ্ধা। এ মুহূর্তে মন কেন কেবলই পাঠক হিসেবে আনত হয় মুক্তিযুদ্ধের এক মহার্ঘ গ্রন্থ “স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন ” এর কাছে। লেখকের একান্ত পর্যবেক্ষণে মুক্তিযুদ্ধ শুধু না এর পরেরও কিছু সময়ের নিঁখুত এক মন ছোঁয়া বর্ননা – বই শেষ করে মনে হয় এক উচ্চমার্গের তথ্য চিত্র “নিঁখুত ও মর্মস্পর্শী “–চিত্রনাট্যের মতো সাজানো -অপ্রিয় কঠিন সত্যি উচ্চারণে নির্মোহ দৃষ্টিতে তিনি এক সাহসী কলম যোদ্ধা। গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়–তরুণদের কাছেও অতি জনপ্রিয় এক গ্রন্থ। একই সাথে আশীর্বাদ হলেও অন্যদিকে কেন যেন মনে হয় এ গ্রন্থের কারণে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে লেখা চিঠি নামে এক সুবিশাল গ্রন্থে ঘাতক দালান নির্মূল কমিটির এক অতি কঠিন সত্যি কথন। যা অনেক মুখোশধারী বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন।
ইতিহাসের বহু পরিবর্তন -ঘাত প্রতিঘাতের ভেতরে থেকেও নির্মাণে প্রতিরোধে সদা সচল থেকে নিজেকে অতিক্রম করেছেন। শিশুবেলায় ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে উপলব্ধি করেছেন। শিশু বেলায় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি করেছেন এবং লিপিবদ্ধ করেছেন ডায়েরিতে। চলমান ছিল এই ডায়েরি লেখার অভ্যাস। পরবর্তীতে ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী সমাজকে নিয়ে রাজপথে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গঠন। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পরিকল্পনা তাঁর বাড়ি মুশতারী লজে। ১৯৭১ এর এপ্রিলে হারালেন স্বামী ও ভাইকে। অতঃপর ওপার বাংলায়। সাথে ছোট ছোট সাত সন্তান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এক শব্দ সৈনিক ও নাট্যশিল্পী। উম্মে কুলসুম নামে নিয়মিত কথক।
লেখালেখি তাঁর আজীবনের সহচর। কিন্তু তিনি সমাজের ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায় যেমন তেমনি নারী মুক্তি -নারী প্রগতির লক্ষ্যে “বান্ধবী পত্রিকার প্রকাশনায় শুধু নয় বান্ধবীকে ঘিরে নারীদের হস্তশিল্প, সেলাই, উলের গরম কাপড় তৈরির বিশেষ ব্যবস্থা সহ নারীরা কম্পোজেও প্রশিক্ষণ নিতেন। একই সাথে ছিল সংগীত শিক্ষার সাথে সংস্কৃতিচর্চা এবং সাহিত্যের মুখপাত্র হিসেবে বান্ধবী সংঘ যা ছিল তৎকালীন নারীদের একান্ত ভুবন। এভাবে নারী জাগরণে তিনি ছিলেন এক আপোসহীন ব্যক্তিত্ব, তীব্র সমাজ সচেতন বিবেক এবং মানবতার জয়গানে সবার ভালোবাসায় সিক্ত মধ্যমণি।
দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে বিবেকের প্রতীক হিসেবে পথে নেমেছেন –বিনীত ও মার্জিত শব্দ বিন্যাসে ও মর্মভেদী কঠোর কঠিন বক্তব্য উচ্চারণ করতেন তিনি।
একজন মানুষ হিসেবে জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে শেষপর্যন্ত তিনি শুধু মহীয়সী নন এক বিপ্লবী যা মৃত্যুতে হারায় না যা অবিনশ্বর। তিনি আমার কাছে ম্যাক্সিম গোর্কির মা। অদম্য সাহসে সব ভয়কে তুচ্ছ করা বিদ্রোহী এক মা অতঃপর হয়ে উঠেন সবার মা।
আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের বিনির্মাণে, নারী সমাজের জাগরণে ও স্বাধীনতার আন্দোলনে, অন্যায বৈষম্যের প্রতিবাদ -প্রতিরোধে –রাজপথে সংগ্রামে ও রাষ্ট্র গঠনে মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে তিনি চিরকালের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর ব্রত ছিল মানুষের কল্যাণ। সততার সাধনায় চারিত্রিক দৃঢ়তা -আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস। কোন রকম পদক পদবি বা খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠার কাছে মাথা নত করেন নি। তাঁর সাথে আমার জীবনের সুবর্ণ সময় কেটেছে গভীর স্নেহে, পরামর্শে ও নির্ভরতায়। সাংস্কৃতিক জীবনের এই আমি তাঁর সৃষ্টি।
তাঁর সুগভীর দেশপ্রেম, সাহসীমন –প্রাগসর চিন্তা ও মনন-মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং সংগ্রামী জীবন আমাদের প্রেরণা। ব্যক্তিজীবনের অনেক কিছুকে একপাশে রেখে যে কোন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় একাত্ম হয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অসাধারণ মহীয়সী নারী। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক আগামী প্রজন্মের মাঝে। ওপারে ভালো থাকুন আপা। আমরা যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক
Discussion about this post