সবুজ ইউনুস
সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী বুধবার দুপুরের দিকে হন্তদন্ত হয়ে আমার কক্ষে এসে বলল, ‘সবুজ ভাই, বিশাল বড় খবর।’ জানতে চাইলাম, কী সেই খবর। ‘সাগরে গ্যাসের বিশাল মজুদ পাওয়া গেছে।’ মেহেদীর উত্তর শুনে মনে হলো, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে।
টিভিতে চোখ রাখলাম। স্ট্ক্রলে যাচ্ছে- সাগরে মিথেন গ্যাসের বিশাল মজুদ আবিস্কার। এ খবর শুনে কিছুটা অবাক হওয়ার পালা। কারণ দীর্ঘকাল এই তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ খাত নিয়ে রিপোর্টিং করেছি। এই খাতে কোথায় কী হচ্ছে টুকটাক খবর রাখার চেষ্টা করি এখনও। বঙ্গোপসাগরে বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করছে। তাদের কাছ থেকে এখনও কোনো বড় সুসংবাদ আসেনি। কিন্তু আকস্মিক বিশাল গ্যাসের মজুদ আবিস্কার হলো কীভাবে! রাশেদ মেহেদীর কাছে ফের জানতে চাইলাম, এই খবর কে দিলেন। উত্তর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সংবাদ সম্মেলন করে এ খবর দিয়েছেন। সাগরে মিথেন গ্যাস পাওয়া গেছে। যার পরিমাণ ১৭ থেকে ১০৩ টিসিএফ গ্যাসের সমপরিমাণ।
বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১১ সালে জাতিসংঘে মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণবিষয়ক কমিশনে বাংলাদেশের পেশ করা মহীসোপানের দাবি সংবলিত প্রতিবেদন তৈরির আগে সরকার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বঙ্গোপসাগরে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিন হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার এবং ২০১০ সালে নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রায় তিন হাজার লাইন কিলোমিটার সিসমিক ও ব্যাথিম্যাট্রিক জরিপ সম্পন্ন করে। এ দুটি জরিপে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে মহীসোপানে ছয় হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চলে থাকা সম্পদের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বাপেক্স, পেট্রোবাংলা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রসীমা অনুবিভাগে সংরক্ষিত। এসব জরিপের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই একটি ‘ডেস্কটপ স্টাডি’ পরিচালনা করা হয়। এই ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ গঠনের পর যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে অবস্থিত ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারসহ পেট্রোবাংলা, বাপেক্স এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের তিন বছরের যৌথ প্রচেষ্টায় ডেস্কটপ স্টাডির কাজ শেষ হয়। সফলভাবে শেষ হওয়া এই ডেস্কটপ স্টাডি থেকেই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
জানিয়ে রাখি, আমরা বাসাবাড়ি, কলকারখানায় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করি। এই প্রাকৃতিক গ্যাস আর গ্যাস হাইড্রেট পুরোপুরি এক জিনিস নয়। এই গ্যাস বিশ্বের বহু দেশেই হাজার হাজার টিসিএফ মজুদ আছে। সহজলভ্য প্রযুক্তির অভাবে কেউ তুলতে পারছে না। ফলে এটা নিয়ে এখনই এত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা কতটা সমীচীন- প্রশ্ন আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনের পর জ্বালানিবিষয়ক একজন সাংবাদিক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, মিথেন গ্যাস হাইড্রেট দুনিয়াতে এখনও কেউ সফলভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, সাগরের গভীরে এই বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস হাইড্রেট তোলা কি সম্ভব? আমি তোলার আগে বলব, এটা তুললে কী হতে পারে? গবেষণা বলছে, এটি যদি তোলা হয়, তাহলে বিপুল পরিমাণ মিথেন ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা ভয়াবহ হবে।
এই গ্যাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা এ রকম। এটাকে বলে, গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন হাইড্রেট। ৪ অনু মিথেন এবং ২৩ অনু পানির সংমিশ্রণ এই হাইড্রেট। এটি মূলত উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফের মধ্যে স্তূপ আকারে থাকে। বালুর ভেতরে ছড়ানো স্ম্ফটিক আকারে কিংবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিণ্ড, শিট বা রেখা আকারে বিদ্যমান থাকে। এই গ্যাস হাইড্রেট থেকে মিথেন গ্যাস পাওয়া সম্ভব, যা ব্যবহারযোগ্য।
সাধারণত সাগরের পানির নিচে নির্দিষ্ট গভীরতা এবং চাপে জমাট আকারে এটি অবস্থান করে। সাগরের অগভীর ও গভীর উভয় অঞ্চলে এটা থাকতে পারে। মেরু অঞ্চলের বরফের নিচে বিশাল এলাকায় মিথেন হাইড্রেটের মজুদ রয়েছে। যা হাজার হাজার টিসিএফ গ্যাসের সমপরিমাণ। সাগরের গভীর থেকে এই মিথেন হাইড্রেটকে তোলার মতো সহজলভ্য প্রযুক্তি আবিস্কারে বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তবে এটাকে ‘ভবিষ্যতের সুখবর’ আখ্যা দেওয়া যায়। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন দ্রুতগতিতে হচ্ছে। আশা করব, অদূর ভবিষ্যতে সাগরের গভীর থেকে এই গ্যাস হাইড্রেট তোলার সহজলভ্য প্রযুক্তি আবিস্কার হবে। বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমা থেকে এই সম্পদ তুলতে সক্ষম হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (সমুদ্রসীমা) মোহাম্মদ খুরশেদ আলমও ওই সংবাদ সম্মেলনে এ রকম আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি ও মজুদের সম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীতে বর্তমানে আবিস্কৃত মোট জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়েও এই গ্যাস হাইড্রেটের পরিমাণ বহু গুণ বেশি। তাপ ও চাপ পরিবর্তন করলে এক ঘনমিটার গ্যাস হাইড্রেট থেকে ১৬০ ঘনমিটার মিথেন গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, চীন, ভারত, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ সম্ভাবনাময় গ্যাস হাইড্রেট নিয়ে নানামুখী গবেষণা চলছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম সমকালকে বলেন, মিথেন হাইড্রেট পাওয়া কোনো বড় ঘটনা নয়। এটি সাগর-মহাসাগরের তলদেশে পাওয়া যায়। ভারতেও প্রচুর মিথেন হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলনের প্রযুক্তি এখনও সহজলভ্য নয়।
সাগরে মিথেন গ্যাসের ‘বিশাল মজুদ’ নিয়ে আমার ছোট প্রশ্নটি হচ্ছে- এই ঘোষণা দেওয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি এর কারিগরি পূর্বাপর ভেবে দেখেছিলেন? এমন গ্যাস যদি তোলাই না যায়, যদি তুলেও কাজে না আসে, তাহলে এমন ঘোষণা লইয়া আমরা কী করিব? মিথেন গ্যাস তুলে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রশ্নটি না হয় উহ্যই রইল।
সবুজ ইউনুস :সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক সমকাল
Discussion about this post