ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির পিতা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই অবিসংবাদিত নেতা পাকিস্তানের কারাগারে ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে অমানবিক নিপীড়নের শিকার হন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেওয়া এ ঘোষণায় সর্বস্তরের জনগণকে দেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে। তাঁর অদম্য নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকরা অবশেষে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর মুক্তির মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় পূর্ণতা লাভ করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে জনগণ বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ পায়। ১০ জানুয়ারি বিকালে রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছালে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায় লাখো জনতা। বীর বাঙালি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর থেকে তাদের প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। এদিন বঙ্গবন্ধু জনস্রোতে সিক্ত হয়ে বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যান। যেখানে তিনি লাখো উল্লসিত বাঙালির সামনে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনায় ভাষণ দেন। তিনি যুদ্ধকালীন সবার অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে উন্নয়নের বীজ বপন করেন। তার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’, একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দেশ অর্জনের পথ হিসেবে একটি স্বনির্ভর অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জন করতে শুরু করে। একটি স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ দেশের সূচনা ঘটে তখন। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে পুনর্বাসন ও জাতি পুনর্গঠনের কঠিন কাজ সম্পন্ন করেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশের স্বীকৃতি, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয়। তিনি একটি আধুনিক সংবিধান গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক জলবণ্টন চুক্তি, ভূমি সীমানা নির্ধারণ এবং ভারতের সঙ্গে শান্তি চুক্তিসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের স্কুল ও কলেজ পুনর্নির্মাণ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.৫%-এরও বেশি অর্জনে সফল হয় বঙ্গবন্ধুর সরকার। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় রাত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারী এবং শত্রুরা বাঙালি জাতির অগ্রগতি বানচাল করার লক্ষ্যে এক জঘন্য অপরাধ করে। শিশু শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও তারা এ দেশকে থামিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর চেতনা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি ও আদর্শ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় চির জাগরুক রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সরকার বাংলাদেশকে ২০২১ সালে মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তকমা মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২৫০০ ডলার ছাড়িয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা। উন্নয়নের মডেল বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪৫টি এশিয়া প্যাসিফিক দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেছেন। সহিংস চরমপন্থা দমনে সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেছে। একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন এশিয়ার ‘উদীয়মান বাঘ’। বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনার দেশ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল এবং নারীর ক্ষমতায়নের দেশ। বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি এখন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের। তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’-এর স্বপ্নের বাস্তব রূপ নিয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তর করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং শিশুমৃত্যুর হার রোধে বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে শিক্ষণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে দেশের মানুষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত নীতি-নির্দেশিকা অনুসরণ করায় বাংলাদেশের এমন অভাবনীয় অগ্রগতির হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মতো।
গত এক দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আইন ও নীতি কাঠামোর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার। তাঁর সোনার বাংলায় কোনও অভাবী মানুষ থাকবে না। মানুষের মৌলিক অধিকারের পূর্ণতা থাকবে বলে স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এমন একটি রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, বিরোধ ও বৈষম্য। এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তিনি চেয়েছিলেন যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করবে। যেখানে ধনী-গরিবের মধ্যে কোনও বৈষম্য কমে আসবে। বিরাজ করবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতার আদর্শকে পরিপূর্ণ রূপ দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে শ্রদ্ধা অনুসরণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। যতদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ টিকে থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এ জাতিকে পথ দেখিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে ধারণ করেই আমরা তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে উদযাপন করতে পারি।
লেখক: অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)। সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।
Discussion about this post