মেসবাহউদ্দিন সরকার
করোনাকালে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার কোনো বিকল্প ছিল না। অভিভাবক তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন/ডিভাইস তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার এসব প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অনেক ছেলেমেয়ে। যদিও শিক্ষার্থী, বিশেষ করে অনেক ছোট শিশুই করোনার আগে থেকেই মোবাইল স্ট্ক্রিনে ডিজিটাল গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ডিভাইস-প্রীতি মাদকের চেয়েও ভয়াবহ। দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার এবং এর তাৎক্ষণিক উপকারিতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
স্মার্টফোনের অপব্যবহারে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেমসে আসক্তি শিক্ষার্থীদের বিকাশে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে অনেক ক্ষেত্রে। দেখা দিয়েছে অল্পবয়সী অনেকের মধ্যে ‘স্ট্ক্রিন অ্যাডিকশন’। স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারে গেম খেলার নেশাকে মানসিক রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস-আইসিডিতে এটিকে গেমিং ডিজঅর্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘক্ষণ টিভির পর্দা, মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাবলেটের মতো ছোট স্ট্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব গেম নিয়ে সমাজতত্ত্ববিদ, মনোরোগ চিকিৎসক এবং সাইবার বিশেষজ্ঞদের চিন্তার অন্ত নেই। কারণ এ ধরনের ভাইরাস গেম হিংসাত্মক আচরণকে প্রশ্রয় দেয়। শিশু মনোবিজ্ঞানী ডগলাস জেনটাইলের মতে, ভিডিও গেমগুলোতে দ্রুত দৃশ্য বদল; আলো, শব্দ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের সর্বক্ষণ পরিবর্তন ও কম্পন এমনভাবে হয়ে থাকে যে, শিশুদের মন ও মস্তিস্কে তা স্থায়ী হয়ে যায়। এ অবস্থায় শিশুরা যখন ক্লাসরুমে যায় তখন সেখানে এ ধরনের কিছু না পেয়ে শিক্ষকের নীরস পাঠদানের প্রতি মনঃসংযোগ থাকে না। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অচেনা জগতে হারিয়ে গিয়ে বন্ধুত্বের নামে ভুল পথে চলছে। ডুবে থাকছে প্রজন্মের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ।
ইংল্যান্ডে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্যালি পেইন তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন ডিজিটাল ট্যাব এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের অবাধ সুযোগ পেয়ে শিশুদের মধ্যে পেন বা পেন্সিল ধরার এবং তা ব্যবহারের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। এক সময় শিশুরা দেখত তার বাবা-মা পেন দিয়ে বাজারের ফর্দ লিখতেন। এখন তারা দেখে, বাবা-মা মোবাইল ফোনে টেক্সট করছেন। ২০১৬ সালের অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ছাত্র হাতে লেকচার নোট লেখেন, তারা পরে সেগুলো অনেক ভালো মনে রাখতে পারেন এবং তাদের ধারণা অনেক পরিচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু কম্পিউটার বা ট্যাবে যারা নোট নেন, তারা অনেক লিখতে পারলেও মনে রাখতে পারেন না। ডিজিটাল আসক্তিতে শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যস্ত জীবনের দোহাই দিয়ে বাবা-মা সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। সন্তানরা পরিবার, আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককভাবে বড় হয়। তাদের সঙ্গী হয় মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের জগৎ। কিন্তু পরিবারের পারস্পরিক বন্ধনের দূরত্ব কোনোদিন যন্ত্র দিয়ে ঘোচানো যায় না। সন্তান যখন বিপথে যায় তখন অনেকের মনে হয়, তার হাতে আদর-ভালোবাসার নামে দামি মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া কতটা ভুল হয়েছে। তাই সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। অনলাইনে সহজলভ্য নানা গল্পের বই পড়ে শোনানো যেতে পারে। অক্ষর চেনা, অঙ্ক শেখা, রং চেনার মতো অনেক শিক্ষণীয় ভিডিও পাওয়া যায় অনলাইনে। তাতে শিশুর সময়ও ভালো কাটবে। তাদের হাতে দেওয়া ডিভাইসের অ্যাপস, গেমস এবং অন্য বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখে নেওয়া উচিত। ‘মীনা-রাজু’, ‘সিসিমপুর’, ‘মাই হর্স স্টোরিজ গেম’, ‘হিপহপ’, ‘ব্যালে’ বা ‘জ্যাজ’, ‘ডান্স স্কুল স্টোরিজ’, ‘আইস স্কেটিং’ বা ‘প্রিটি ব্যালেরিনা’, ‘চিয়ারলিডার ড্যান্স অব চ্যাম্পিয়নশিপ’ ইত্যাদি শিশুতোষ ভিডিও করোনাকালে শিশুশিক্ষায় যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ছাড়া ছবি আঁকা, নাচ-গান, গল্প-কবিতা আবৃত্তি, এমনকি মা-বাবার সঙ্গে ঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, রান্নাবান্না, ছাদ-বারান্দা বাগান পরিচর্যা, হালকা ব্যায়াম ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত করলে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি অনেকটা কমে যাবে।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post