এ কে এম শাহনাওয়াজ
ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা ভাষার প্রশ্নে নড়েচড়ে উঠি। বাংলা ভাষার মর্যাদা নিয়ে কথা বলি। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে পৃথিবীর তাবৎ ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে আমাদের দায়দায়িত্বের কথাও বলি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় মুখর-মুখরা জ্ঞানীজন টকশো মুখরিত করেন। চমৎকার শব্দমালায় বক্তৃতার মঞ্চ আমোদিত হয়। পত্রিকার পাতায় নানা শিরোনামে প্রকাশিত হয় নিবন্ধ। যেমনটি আজ আমি লিখছি। আসলে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর গুরুত্ব এখানেই যে, অন্তত সেই বিশেষ দিন যে চৈতন্য ধারণ করে আছে, সারা বছর তা পাথরচাপা থাকলেও বছরের বিশেষ সময়ে দৃশ্যমান হয়। এতেও যদি নতুন করে প্রাণিত হতে পারে দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ এবং নীতিনির্ধারকরা-তাহলেই বা মন্দ কী!
ইংরেজিমাধ্যমে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দ্রুতই। দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি শেখার তেমন অবকাশ নেই এদের পাঠক্রমে। ইদানীং সরকারি কর্তৃপক্ষ ইতিহাসচর্চার প্রতি বৈরী আচরণ করছে। তারা বোধহয় চাচ্ছে ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম যাতে দেশপ্রেমের চেতনা থেকে দূরে থাকে। সচেতন প্রজন্ম তৈরি না হওয়াই নিরাপদ। তাই ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ বলে স্কুলে আলাদা কোনো বই রাখা হয়নি। আর এতকাল রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চায় আটকে থাকায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জানা থেকে এমনিতেই বিচ্ছিন্ন এ প্রজন্মের অনেকে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এ ধারার শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠক্রম বিন্যাসের দুর্বলতার কারণে যতটা ভালো ইংরেজি বলতে পারছে, ততটা ভালো দখল দেখাতে পারছে না ইংরেজি ভাষা ও গ্রামারে। বিশেষ করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন এদের মধ্যে দেশাত্মবোধ তৈরি হওয়াটা খুব কঠিন।
আলিয়া ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলামাধ্যম মূলধারার সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কিত। তাই বাংলামাধ্যম শিক্ষার অনুরূপ সংকট এ অঞ্চলেও রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সংকটে আছে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। এদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশ কওমি মাদ্রাসায় পড়ে। আরবি, ফারসি ও উর্দু কওমি মাদ্রাসার শিক্ষামাধ্যম। বাংলা ও ইংরেজির সঙ্গে এদের সম্পর্ক কম। দেশ, জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অনেকের ধারণা খুব অস্পষ্ট। এরা দেশ ও সমাজের বোঝায় পরিণত হচ্ছে। একটি জাতির সংস্কৃতি তার ভাষার বাহনে চড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা হারিয়ে ফেললে নতুন প্রজন্ম সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ফলে যে কোনো অশুভ শক্তি তাদের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করতে পারবে সহজেই। পাকিস্তানি শাসকচক্র এ সত্য ১৯৪৭ সালেই বুঝেছিল। তাই বাংলা ভাষার ওপরই প্রথম আঘাত হানে। আমাদের পূর্বসূরিরা আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে আত্মপরিচয়কে সমুন্নত রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু চৈতন্য-বিচ্ছিন্ন আমরা নানাভাবে একে লালন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। একধরনের উগ্র আধুনিকতা ও অপূর্ণ বৈশ্বিক ভাবনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির বিকৃত ধারণা থেকে আমরা বাঙালি সংস্কৃতির বিকলাঙ্গ অবয়ব উপস্থাপন করছি। আমাদের চারপাশে অর্থবিত্তে আভিজাত্য খোঁজা অনেক পরিবারকেই পাওয়া যাবে যাদের বাংলা ভালো বলতে না পারা বা লিখতে না পারার মধ্যে এক ধরনের অহমিকার ছোঁয়া থাকে।
আমার শিক্ষক প্রয়াত খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক ক্লাসে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি গল্প বলেছিলেন। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে এ গল্পটি নতুন করে মনে পড়ে আমার। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে স্যার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ছিলেন। সে সময়ে তাদের বাসায় এক বিহারি ভিক্ষুক আসতেন। ভিক্ষা চাইতেন তার প্রতিদিনের ভাষা উর্দুতে। মুক্তিযুদ্ধের পর একদিন স্যারের দরজায় সেই বৃদ্ধ ভিখিরি। যথারীতি উর্দুতেই ভিক্ষা চাইছেন। আমার মুক্তিযোদ্ধা স্যারের কাছে এবার বিসদৃশ লাগল। তিনি বললেন, বাংলায় ভিক্ষা না চাইলে তিনি ভিক্ষা দেবেন না। অসহায় হয়ে পড়লেন ভিক্ষুক। উপসংহার টানলেন স্যার। বললেন, ও বেচারা হয়তো ঢাকায় কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের সবচেয়ে বড় সময়। কিন্তু জীবনযাত্রার কোনো পর্যায়েই তার বাংলা শেখার দায় পড়েনি। ভাঙা-আধাভাঙা উর্দুতে তাকে সাহায্য করেই আমরা গৌরববোধ করেছি। অর্থাৎ আমরা আমাদের আত্মমর্যাদাবোধকেই যেন খুঁজে পাইনি।
সামাজিক জীব হিসাবে বসবাস করতে হয় বলে নিজের নেওয়া শপথ নিজেকেই ভাঙতে হয় বারবার। বাঙালি পরিবারের বিয়ে ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে ইংরেজি ভাষায় দাওয়াতপত্র পেলে তেমন অনুষ্ঠানে যাব না বলে একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সামাজিকতার দায়ে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারি না। এ প্রবণতা ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারও ইংরেজিতে দাওয়াতপত্র লিখে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় বিয়ে অনুষ্ঠানে শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত নানা স্তরের আত্মীয়কে দাওয়াত দিতে হয়। একসময় দেখতাম ডাক ঘরে অশিক্ষিত মানুষের চিঠি লিখে দেওয়ার জন্য পয়সার বিনিময়ে লেখক থাকতেন। এখন বোধহয় বিয়ের দাওয়াতপত্র পড়ে দেওয়ার জন্য আরেকটি পেশা সৃষ্টি হতে পারে।
নতুন প্রজন্মকে স্বাজাত্যবোধ থেকে দূরে সরাতে আমাদের অনেক টিভি চ্যানেল আর বেসরকারি রেডিও কম কসরত করছে না। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তৈরি অনেক অনুষ্ঠানে এবং বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার পর্যালোচনার সময় উপস্থাপক ‘প্রিয় দর্শক’-এর বদলে ‘ভিউয়ার্স’ বলে হাত-পা ছুড়ে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত উচ্চারণে ইংরেজি শব্দ বলে এক ভয়ংকর খিচুড়ি বানাতে থাকে।
বাংলা একাডেমি একটি প্রমিত বাংলা বানানরীতি প্রণয়ন করেছে। আবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তাদের বই লেখার জন্য একটি বানানরীতি ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লিখতে গিয়ে আরেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আমার প্রমিত বানানরীতির কোনো কোনো বানান সংশোধন করা হয়। জানতে চাইলে বলা হয়, এটি এ পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালা।
এসব অসংগতি দেখলে বোঝা যায়, একুশের চেতনা আমাদের চৈতন্যোদয় ঘটাতে পারেনি এখনো। একুশের চেতনা অন্য ভাষাকে বৈরী জ্ঞান করা নয়-নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান দেওয়া। আত্মগৌরববোধ ছাড়া নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমিক হতে পারবে না। নিজ দেশ নিয়ে বড় স্বপ্ন বুনতে পারবে না।
কিন্তু আমার ভয় হয় আমাদের চেতনার বিকলাঙ্গ দশা দেখে। প্রায় এক দশক আগে থেকে প্রতি ফেব্রুয়ারিতেই আমি নিবন্ধ লিখে হারিয়ে যাওয়া প্রভাতফেরিকে ফিরিয়ে আনার জন্য হা-হুতাশ করি। কিন্তু পাত্তা পাই না কোনো অঞ্চল থেকেই। আমার মনে হয়, প্রভাতফেরি ছিনতাই হওয়ার পর থেকেই গুবলেট হয়ে গেছে একুশের চেতনা। প্রভাতফেরি শব্দটি শুধু একুশের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। বাঙালি সংস্কৃতির এ যেন প্রতীকী শব্দ। বাঙালি সংস্কৃতিতে দিনের হিসাব প্রত্যুষ থেকে সন্ধ্যা। তাই একুশের প্রথম প্রহর প্রত্যুষে খালি পায়ে একুশের গানের সুর-মূর্ছনায় শহিদমিনারে যাওয়ার আলাদা রোমাঞ্চ ছিল। কিন্তু একপর্যায়ে সামরিক ও সামরিক মদদপুষ্ট শাসকরা নিজ নিরাপত্তার প্রশ্নে পাশ্চাত্যের হিসাবে মধ্যরাতে একুশের প্রহর গুনতে শুরু করে। মুখরিত করে শহিদমিনার। আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তথাস্তু বলে মেনে নেয়। এভাবে নতুন প্রজন্ম প্রভাতফেরি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে একুশের চেতনায় যে স্বাতন্ত্র্য আছে, তা এদের পক্ষে অনুভব করা কঠিন হয়ে যায়।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলের সব দেশপ্রেমিক মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধভাবে একুশের চেতনাকে ফিরিয়ে এনে জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির নীতি প্রণয়ন করেন তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে। দেশাত্মবোধহীন জাতি কি দেশের সার্বিক উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে পারে?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post