ড. উজ্জ্বল কুমার দেব
পৃথিবীতে বাঙালি মনে হয় একমাত্র জাতি যাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বাংলাকে ভাষা হিসেবে পেয়েছি, ভাষার মাসে সে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। কয়েকদিন আগে দেখলাম কাজীর দেউড়ি মোড়ে এক দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা লেখা না থাকাতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট সাইনবোর্ডটি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন।
সারা বছর আমরা এ ধরনের উদ্যোগ দেখতে পাই না। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম, তবে সেটা বাংলা কে অবহেলা করে নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪ সালে গঠিত কুদরত- ই -খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলায় হতে হবে বলে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সেটা কখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে আমাদের হীনমন্যতা অনেকটা দায়ী ছিল।
মৌলিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা গুলো বোধগম্য হওয়ার জন্য মাতৃভাষার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বাংলা মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে বিষয়গুলো সব ইংরেজিতে হওয়াতে প্রথমদিকে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হয়েছিল। বিশেষ করে পদার্থবিদ্যার বিষয়গুলো। তখন বাংলা একাডেমি থেকে অনূদিত রেসনিক-হেলিডে এর পদার্থ বিজ্ঞান বইটি পড়ে খুব উপকৃত হয়েছিলাম। মূলত পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণার উপর নির্ভরশীল জটিল জিনিস গুলো মাতৃভাষায় হওয়াতে সহজেই বোধগম্য হয়েছিল।
তখনই বুঝতে পেরেছিলাম মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব। বিজ্ঞানকে মাতৃভাষার মাধ্যমে চর্চা করার জন্য চট্টগ্রামের যে কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্ব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যার অন্যতম। স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে একুশে পদকে ভূষিত করেছিলেন শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে স্যারের ছিল অপরিসীম আগ্রহ। কোন এক সাক্ষাৎকারে স্যার বলেছিলেন, মূলধারা শিক্ষা প্রধান উপকরণ হওয়া উচিত বাংলা। তবে বাংলা স্কুলে ইংরেজির মান ভালো করতে হবে। এদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল জ্ঞানীগুণী আমরা দেখতে পাই তাঁদের প্রায় সবাই বাংলা মাধ্যম থেকে এসেছেন। দেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে হলে বাংলা অবশ্যই জানাটা জরুরি এবং তা বাংলা মাধ্যমে করতে হবে। ইংরেজি মাধ্যম থেকে আসা ছেলেদের সাধারণত বাংলায় দুর্বলতা থাকে ।
রাহাত সিরিজ প্রকাশনা থেকে স্যারের বেশ কয়েকটি বই বের হয়, তার মধ্যে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বলেছেন বিজ্ঞানের এমন কিছু মৌলিক বিষয় আছে যেগুলোর মূলভাব বুঝতে হলে মাতৃভাষায় মাধ্যমে ভালোভাবে বোধগম্য হয়। বাংলা একাডেমী থেকে ‘কৃষ্ণবিবর’ নামে ১৯৮৫ সালে জামাল স্যারের প্রথম বাংলা বই বের হয়। এটি অমর একুশে বই মেলায় প্রথম পাওয়া যায়। তিরাশি পৃষ্ঠার এই বইটি তখন দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী থেকে শুরু করে সাধারণের পাঠ্য এই বইয়ে অনাগত ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের কি পরিণতি হবে এবং এক্ষেত্রে কৃষ্ণবিবরের ভূমিকা কি হবে, সহজ ভাষায় তার একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন স্যার।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল বাংলা ভাষায় ব্ল্যাকহোলের একটি মৌলিক সংযোজন আমরা হাতে পাই বাংলা একাডেমির মাধ্যমে সেটি হল এই বইটি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বইটি বর্তমানে পাওয়া যায় না এবং বাংলা একাডেমিও এটি আর নতুন করে প্রকাশ করছে না।
যে বইটির জন্য জামাল স্যার বিশ্বের বুকে সুপরিচিত সেটি হলো- দি আলটিমেইট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স। বাংলা করলে দাঁড়ায় মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি। সারাবিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে সমাদৃত এই বইটি ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। জাপানি, ফরাসি সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি । কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বিখ্যাত বইটি অনূদিত হয়নি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষায় বাংলায়।
অবশেষে প্রকাশের প্রায় চার দশক পর বইটি অতি সমপ্রতি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অনঙ্গভূষণ দাস নামের একজন সাহিত্যকর্মী। অনেক দেরিতে হলেও বইটি বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আশাকরি কৃষ্ণবিবর বইটির মতো মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে স্যারের লেখা এই বইটি পাঠক সমাদৃত হবে।
নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞান খেলাঘর আয়োজিত একটি বিজ্ঞান বক্তৃতায় স্যার বলেছিলেন, আমরা আজ যে বিশ্ব দেখছি সেটা ঠিক এই মুহূর্তের বিশ্ব নয়। অনেক দূরের নক্ষত্র থেকে আলো আসতে লাগে কোটি কোটি বছর। সুতরাং কোটি কোটি বছর আগে বিশ্ব ঠিক কেমন ছিল তাই আজ আমাদের কাছে দৃশ্যমান। কথাটি শুনে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। আমরা আজ যা দেখছি তা কোটি বছর আগের দৃশ্য, আর স্যার হিসেব করেছিলেন আজ থেকে কোটি বছর পরে এই মহাবিশ্বের পরিণতি কী হবে । বিশ্বপ্রকৃতিকে গণিত ও বিজ্ঞান দিয়ে উনি বুঝেছিলেন। সম্ভবত ২০০১ সালের দিকে একবার গুজব রটেছিল গ্রহ নক্ষত্র গুলো একই সরলরেখা বরাবর চলে আসছে, অতএব পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। জামাল স্যার রীতিমতো গণিতের হিসাব কষে দেখান গ্রহ-নক্ষত্রের এই চলন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। গ্রহ গুলো যেভাবে বিশ্ব মন্ডলের সরলরেখায় এসে খাড়া হচ্ছে এটা অস্বাভাবিক কিছু না । মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়ার মতো কোনো বিপদ দেখা দেয়নি।
এভাবেই তিনি মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তার বিষয়টিকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন । স্যার ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানী। চিন্তাকে বার বারই বুদ্ধির সীমা ভেদ করে প্রজ্ঞার জগতে প্রবেশ করতে হয় । সেটা গণিত ও বিজ্ঞানের জগৎ নয়, দিব্যজ্ঞানীর জগৎ। এই দিব্যজ্ঞান দিয়েই স্যার মহাবিশ্বের চরম পরিণতি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন।
আমরা সবাই স্যারের দেশপ্রেমের কথা ভালভাবেই জানি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেছিলেন। প্রাচুর্যে ভরা বিদেশের আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন এবং অনেককে উচ্চ শিক্ষা শেষে দেশে ফিরতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সবসময় চাইতেন, আমার দেশ স্বনির্ভর হোক এবং বিদেশী দাতা সংস্থার উপর নির্ভর না করুক। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর সাহায্য গ্রহণের ব্যাপারে জামাল স্যারের ছিল প্রচণ্ড অনীহা।
তাঁর মতে এটি আমাদের দেশে এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। এটি কতিপয় ধনী ব্যক্তি কে আরো ধনীতে পরিণত করছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোন উপকার হচ্ছে না। আমাদের এটি প্রতিরোধ করতে হবে। তবেই আমরা গর্বিত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। স্যারের কথাটির প্রতিফলন আমরা সমপ্রতি দেখতে পেয়েছি। আমরা জানি বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই বাংলাদেশের মানুষের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরি করেছেন। স্যার আরও বলতেন আমরা যদি নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভর করি, তাহলে অপব্যয় কম হবে এবং আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে। বিদেশি সাহায্যের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা উৎপাদনের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলছি।
স্যারের একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে। তাহলো আই নেভার এভার ইউজ ক্যালকুলেটর ইন মাই লাইফ। মোবাইল ব্যবহারের প্রতিও স্যারের ছিল প্রচণ্ড অনীহা। বলতেন এটা মানুষের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা কমিয়ে, আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্র। ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্যার তরুণ প্রতিযোগীদের অনুরোধ করেছিলেন “তোমাদের মোবাইল গুলো পুকুরে ফেলে দাও।” বর্তমানে আমরা দেখতে পাই যুব সমাজের অবক্ষয়ের মুল কারণ অনিয়ন্ত্রিত মোবাইলের ব্যবহার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলাভাষা হচ্ছে আমাদের চেতনার জায়গা।
বাংলাভাষাভাষী একটি জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে হলে, বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোর অপার সৌন্দর্য আর বিস্ময়কর জগতের সাথে পরিচয় করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে হবে সেই চেতনার মর্মমূলে। সে জায়গায় পৌঁছাতে হলে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।
Discussion about this post