মাজহার মান্নান
শিক্ষকতা পেশায় থাকার কারণে শিশু-কিশোরদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় প্রায় প্রতিদিনই। শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ব নিয়ে কিছু গবেষণাও আমি করেছি। কোন কোন বিষয়গুলো শিশু-কিশোরদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেটা আমরা কম বেশি সবাই জানি। কিন্তু শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ব নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের ধারণা একটু ভিন্ন হয়।
একটি শিশু ছোট থেকে একটি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় হয়। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিষ্টাচার, বন্ধন, স্নেহ, ভালোবাসা, সামাজিক অনুশাসন, বডি ল্যাংগুয়েজ, পারস্পারিক প্রতিক্রিয়া, আচরণ ইত্যাদি। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো স্তরে যদি কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে সেটার নেতিবাচক প্রভাব শিশু-কিশোরদের ওপর পড়ে। শিশুরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে অনুকরণ করতে। আর এই অনুকরণ সে তার নিজস্ব পরিবেশ থেকেই করে থাকে। তাই শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ যদি অনুকূল হয়, তাহলে সে সুষ্ঠভাবে বেড়ে উঠে। আর প্রতিকূল হলে সে সমাজের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তির ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি অবশ্যই মানবকল্যাণ্যের জন্য এক বড় আশীর্বাদ। কিন্তু এটা যে কখনো কখনো বড় বিপদের কারণ হতে পারে, সেদিকে আমাদের নজর মনে হয় একটু কম। প্রযুক্তির একটি বড় অবদান স্মার্টফোন। এই যন্ত্রটি ছাড়া আমরা একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না। এই যন্ত্রটি আমাদের অনেক কাজে লাগে বলেই এটার প্রতি আমাদের এত ঝোঁক। কিন্তু এই যন্ত্রটি একটি শিশু বা একটি কিশোরের হাতে কতটুকু নিরাপদ?
আমরা এমনিতেই মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। কিশোর তরুণদের হাতে আজ মাদক তুলে দেয়া হচ্ছে। মাদক গ্রাস করেছে বহু তরুণের জীবন। মাদকের নেশায় তরুণ সমাজের অনেকে বুঁদ হয়ে বিপৎগামী হয়েছে। মাদকের ভয়াল থাবা প্রতিনিয়ত তৈরি করছে কিশোর অপরাধীদের। আজ দেশে প্রচুর কিশোর গ্যাং তৈরি হয়েছে এবং আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। মাদকের নেশা থেকে কিশোর তরুণদের বাঁচাতে যখন আমরা হিমসিম খাচ্ছি, ঠিক তখনই স্মার্টফোন নীরবে শিশু-কিশোরদের জন্য আরেক বড় নেশা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাদকের নেশা থেকে মোবাইলের নেশাকে কোনো অংশে নগণ্য করে দেখার সুযোগ নেই।
আজ প্রতিটি ঘরে প্রতিটি শিশু-কিশোরের হাতে স্মার্টফোন। এক চরম নেশায় বুঁদ হচ্ছে আমাদের শিশু-কিশোর। অভিভাবকরা কোনোমতেই যেন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না এই ঘাতক নেশাকে। অসহায় হয়ে হয়তো বাচ্চাকে মারধর করছেন যেটা শিশুর ওপর আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আবার শিশুর হাতে স্মার্টফোন না দিয়ে তাদের উপায় নেই। কেননা একটি শিশু ভাবে যে, তার সব বন্ধুর হাতে স্মার্টফোন, তাই তারও একটি চাই। ভালো-মন্দ বুঝার ক্ষমতা তাদের নেই। তবে কান্নাকাটি করে সে সেটা নেবেই।
কতটা ভয়াবহ অবস্থা চলছে, তা একটি দৃষ্টান্ত দিয়েই বলি। আমি যেহেতু শিক্ষক তাই অনেক অভিভাবক আসেন তাদের সন্তানের স্মার্টফোনটি আমার কাছে জমা রাখতে। তাদের এককথা, স্যার আর পারছি না। কিছু একটা করেন। তাদের অসহায় মুখটি দেখে নিজের কথাও ভাবি। আমারও তো শিশু ঘরে আছে। তারও তো একই নেশায় আচ্ছন্ন। অভিভাবকদেরই কি করার আছে। শিশু-কিশোরদের উম্মুক্ত মাঠে বা প্রান্তরে খেলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। শহর অঞ্চলে এ সুযোগ নেই বললেই চলে। তাহলে ঘরে বন্দি শিশুরা কি করবে। কিভাবে কাটবে তাদের সময়। নিরাপত্তার কথা ভেবে শহরে বাবা-মায়েরা সন্তানদের বাইরে যেতে দিতে চায় না। তাহলে শিশুর মাঝে স্বতঃস্ফূর্ততা আসবে কিভাবে? সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার সংস্পর্শে আসার তাদের সুযোগ কোথায়। একটি বদ্ধ খাঁচায় তারা বেড়ে উঠছে। কিভাবে তবে গড়ে উঠবে তাদের উদার ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতা। আমরা গ্রামে বড় হয়েছি। কোথায় খেলতে চলে গেছি বাবা মা ততটা খোঁজও রাখতো না। হয়তো এখনকার মতো তখন নিরাপত্তা নিয়ে তাদের ভাবতে হতো না।
আজকাল কত শতাংশ শিশু সাঁতার জানে? এ বিষয়ে কোনো সঠিক সমীক্ষা নেই। একটু চিন্তা করুন। আমাদের প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটতো সাঁতার কেটে। চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে মায়ের কিছুটা চোখ রাঙানি কতটা মধুর ছিল। বিকাল হলে ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড়। মাঠ না পেলে কোন কৃষক ধান কেটে জমিটা ফেলে রাখলে সেখানেই খেলা চলতো। আজ শিশুদের মাঝে তেমন কোন উদ্যমতা দেখা যায় না। মোবাইলের প্রতি তারা বিভোর। অনলাইনে গেম খেলা তাদের জীবনের বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পাবজিসহ আরও কিছু অনলাইন খেলা আছে যেগুলো কয়েকজনে মিলে খেলা যায়। অনালাইন খেলায় তারা বিজয় ছিনিয়ে নিতে মরিয়া। অথচ তাদের এ সময়ে মাঠে থাকার কথা ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলায় তাদের মেতে উঠার কথা ছিল। অনলাইনে দীর্ঘ সময় খেলার কারণে তাদের চোখ, স্মৃতিশক্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়। শরীরে পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব।
একটি শিশু মাঠে গিয়ে খেললে তার শরীর গঠন হয়, মানসিক পক্কতা আসে, নেতৃত্বদানের দক্ষতা তৈরি হয় এবং সৌজন্যবোধ শিখে। স্মার্টফোন আজ শিশু-কিশোরদের জীবনী শক্তিকেই যেন চুষে খাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের এই স্মার্টফোন নেশা তাদের শিশুত্বকে নষ্ট করে দিচ্ছে। মেধাশক্তিহীন হয়ে পড়ছে এ সকল শিশু-কিশোররা। করোনা মহামারিতে স্মার্টফোনের প্রতি শিশু-কিশোরদের নেশা অনেক গুণ বেড়েছে। ঘরবন্দি জীবন আর অনলাইন ক্লাসে থেকে থেকে তাদের আসক্তির মাত্রা বহু গুণে বেড়ে গেছে।
একটি বেসরকারি পর্যায়ের জরিপে দেখা গেছে, বাবা-মায়েরা চাকরি করেন তাদের সন্তান মোবাইল আসক্তিতে বেশি ভুগছে। সন্তানকে শান্ত রাখার জন্য বাবা-মা হয়তো মোবাইল তাদের সন্তানের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন না যে, কতটা এই মোবাইলের কারণে কতটা অশান্ত হয়ে উঠছে শিশুদের মন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মোবাইল শিশুদের বহুবিধ ক্ষতি করে থাকে। এটি শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ততাকে নষ্ট করে, শিশুর মাঝে হতাশার সৃষ্টি করে। এক ধরনের বিরুপ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠে শিশুরা। অলাইন দুনিয়ার মন্দ সাইটগুলোর সংস্পর্শে আসে এসব কোমলমতি শিশুরা। তাদের মন বিগড়ে যায়। বাধাগ্রস্ত হয় তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা। এক ধরনের মানসিক বৈকল্য তৈরি হয়। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সমাজে বড় হয়ে উঠে যা বিপজ্জনক।
চিকিৎসকরা বলেছেন, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শিশুদের মধ্যে নিম্নোক্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়—
১. হীনমন্যতা ২. অটিজম ৩. স্বার্থপর মানসিকতা ৪. অমনোযোগ ৫. হতাশা ৬. বিদ্রোহী মনোভাব ৭. কিশোর অপরাধ ৮. জীবনের প্রতি উদাসীনতা ৮. দুশ্চিন্তা ৯. সাইবার বুলিং ১০. আত্মহত্যার প্রবণতা ১১. যৌন হয়রানি ১২. ধর্ষণ।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৩ জন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ১ জন শিশু। প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ শিশু ইন্টারনেট দুনিয়ায় সংযুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর ২৫ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম। ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৭- ২৮ বছরের মধ্যে।
মোবাইলে শিশুদের আসক্তির কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের লেখাপড়া। অধিক রাত পর্যন্ত শিশুরা জেগে থাকে মোবাইল হাতে নিয়ে। কোন বন্ধুর কোন নতুন মেসেজ এলো কিনা সেটা দেখতে গভীর রাত পর্যন্ত তারা জেগে থাকে। যার ফলে শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। শহরের শিশুরা সকাল ৯টা পর্যন্ত ঘুমায়। তাদের ঘুম ভাঙাতে বাবা মার গলদঘর্ম হতে হয়। যা হোক, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে একটি অন্যতম কারণ মোবাইল আসক্তি। এখন প্রশ্ন হলো, এর সমাধান কোথায়? বিষয়টি যত সহজে বলা যায় বাস্তবতা অনেক কঠিন। বাবা-মা যদি সহজে পারতো তবে এতদিন হয়তো সমস্যা সমাধান হয়ে যেত।
আর কি কি উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমি বলবো, রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন আছে। অনলাইন গেমকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। স্মার্টফোনে কোনভাবেই যে পর্ণসাইট কানেক্ট না হয় সে বিষয়ে রাষ্ট্রকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এরপরের ভূমিকা নিতে পারে বিদ্যালয়সমূহ। শিশু-কিশোররা প্রায় ৮ ঘণ্টা বিদ্যালয়ে থাকে। এ সময়ে তাদের কাছে স্মার্টফোন যেন না থাকে সেটা বিদ্যালয়কে নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের সাথে যোগাযোগের দরকার হলে বাটন সেট ব্যবহার করতে পারে। তৃতীয় ধাপে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বাবা-মা। তাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তারা যদি গা ছাড়া দিয়ে চলে তবে শিশুদের মোবাইল নেশা আরও বৃদ্ধি পাবে। যে কোন কৌশলেই হোক তাদের সেটা করতে হবে। সন্তানকে সময় দিতে হবে। তাদেরকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে। তাদেরকে মাঠে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে নিজে সাথে যেতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কাজে বাবা-মা তাদের সন্তানকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। আসলে এককভাবে কারো পক্ষে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। একটি সামাজিক আন্দোলন। আজ যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে কারও যেন সময় নেই। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মা নিজেরাও মোবাইল নিয়ে বেশেরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন। এসব প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কিশোর-তরুণদের মাঝে বৃদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ তৈরি করতে হবে। লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসতে হবে শিশুদেরকে অনুপ্রাণিত করতে।
শিশুরা সহজে অনুকরণ করে। তাই ওরা যেন ভালো কিছু অনুকরণ করতে পারে, সে ব্যবস্থা আমাদের বড়দের করতে হবে। মোবাইল আসক্তি শিশুদের মাঝ থেকে দেশপ্রেমবোধের স্পৃহাকে কমিয়ে দিচ্ছে, যেটা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। শিশুদের মাঝে দেশপ্রেম জাগাতে হবে। ছোট থেকেই শিশুরা যেন দুর্নীতিকে ঘৃণা করেতে শিখে, সে ব্যবস্থা বড়দের করতে হবে। শিশুর মন পবিত্র এবং কোমল। এই কোমল মনকে যেভাবে আমরা গড়ে তুলব, সেভাবেই তারা গড়ে উঠবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ,বি এ এফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাস
Discussion about this post