ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া
‘স্বাধীনতা’ এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো! বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে উপজীব্য করে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়-
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রাজনীতির কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর সৃষ্টি- বাঙালি জাতির চিরঞ্জীব অনুপ্রেরণার এক মহাকাব্য। যে মহাকাব্যটি বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এমন মহাকাব্যিক ভাষণ উচ্চারণ সম্ভব ছিল। কেননা তিনিই ছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ইতিহাস আর কাউকে সেই অথরিটি প্রদান করে নাই।
পৃথিবীর ইতিহাসে সেরা রাজনৈতিক ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অনন্য সাধারণ ভাষণটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। পৃথিবীর অন্য সব সাড়া জাগানো ভাষণ ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোন প্রকার লিখিত পাণ্ডুলিপি বা নোটস ছাড়াই অবলীলায় যেন রাজনীতির এক কবিতা পাঠ করেছিলেন সেদিন।
১১০৫ শব্দের প্রায় ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডে, মিনিটের হিসেবে গড়ে ৪৮ থেকে ৫০টি শব্দ বের হয় বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে। কোনো প্রকার শব্দের পুনঃউচ্চারণ ও বাহুল্যবর্জিত এ ভাষণটি শুধু বাঙালির শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাসের বিবৃতি ও স্বাধীনতার ঘোষণাই নয়, একই সাথে শব্দচয়ন ও স্বতঃস্ফূর্ত বাক্য বিন্যাসে গাঁথা যেন কোন বাকশিল্পীর একটি মহাকাব্য। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মনের সমস্ত কথা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন জনতাকে ‘আপনি’ সম্বোধনের মধ্য দিয়ে।
‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ তাঁর তর্জনীতে ছিল বাঙালির স্বপ্ন- আকাক্সক্ষার সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি। ৭ মার্চের ভাষণের অপর একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু প্রতিপক্ষ ইয়াহিয়া ও ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম উচ্চারণের সময় সৌজন্যবোধ প্রদর্শন করেছেন। ভাষণে একাধিকবার তিনি ʻইয়াহিয়া খান সাহেব’, ‘ভুট্টো সাহেব’ বলে সম্বোধন করেছেন।
যেমন, বঙ্গবন্ধু ভাষণের এক জায়গায় বলেছেন, ʻতিনি [ইয়াহিয়া খান] আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি এই সৌজন্যতাবোধ লালন করেছিলেন।
মানুষের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে পৃথিবীর অনেক মহান নেতার ভাষণ ইতিহাসের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। কিন্তু তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক সরকার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির চিরলালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা ও মুক্তির সাহসী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে কালজয়ী ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণটি হয়ে উঠেছিল একটি জাতির পরিত্রাণের মহামন্ত্র। তাই ৭ মার্চের ভাষণটি সর্বকালের সেরা।
৭ মার্চের ভাষণের আর একটি বলিষ্ঠ দিক হচ্ছে ন্যায়নিষ্ঠা ও যুক্তিবাদিতা। যেমন তিনি বলেন, “আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে [প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান] অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন যে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা একটি ঘোষণার অপেক্ষাতেই ছিল; আর তা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা। তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ এনে রাষ্ট্রীয় সংহতির নামে সামরিকপন্থা অবলম্বন করার সুযোগ তৈরি হবে। ৭০-এর নির্বাচনে তাঁর বিপুল বিজয় ও ম্যান্ডেট লাভ গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
একজন অতিসচেতন ও সতর্ক জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি সামরিক জান্তার ঐ ফাঁদে পা দেননি। সামরিক আমলাদের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’-এ উল্লেখ করেছেন, সেদিন (৭ মার্চ) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) রেসকোর্সের চারদিকে সশস্ত্র সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন এবং শাহবাগের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের মতো উঁচু জায়গাগুলোতে মেশিনগান ফিট করা হয় যাতে শেখ মুজিবুর রহমান বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা করার সাথে সাথে তাঁর ও শ্রোতাদের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদের অজুহাতে অতর্কিত হামলা করা যায়।
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এর আহ্বান ছিল মূলত বাংলার স্বাধীনতার এক ধরনের দিক-নির্দেশনা। একজন দক্ষ, সুনিপুণ, কৌশলী সমরনায়কের মতো ভাষণের শেষের দিকে তিনি স্বাধীনতার কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, যাতে ঘোষণারও কিছু বাকি থাকল না, অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করে অ্যাকশনে যাওয়াও সহজসাধ্য ছিল না। বিষয়টি লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Daily Telegraph পত্রিকার প্রতিনিধি David Loshak ঢাকা থেকে প্রেরিত ʻThe end of the old Pakistan’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেন,
“On Sunday (March 7) Sheikh Mujib came as near to declaring this (Independence) as he could without inviting immediate harsh reaction from the army.”
এটি রাজনৈতিক মহাসমাবেশে কোনো নেতার প্রতিদিনের ভাষণদান নয়, এ যেন জনতার মুক্তিদিশারি কোনো কবির সভামঞ্চ থেকে একের পর এক ছন্দময় কবিতার পঙক্তি রচনা করে বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেছিল `Poet of PoliticsÕÕ হিসেবে। সেখানে বলা হয়, `Sketch a Simillar Emotive figure and and Artistic altrurism of Sheikh Mujib by terming him a ÔPoet of Politics.’
৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ঘোষণা দেওয়ার পর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন, `You will see history made if the conspirators fail to come to their senses.’ আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধুর এই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ বছর শেষ হতে না হতেই ফলে গিয়েছিল। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছিলো স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জন রিড (John Reed) রচিত বিশ্বখ্যাত ʻTen Days That Shook the World’ বইতে উল্লেখিত যে ক’টি দিনে রাশিয়ায় মহামতি লেলিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে ঐ ১৮ দিন স্বাধীনতার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের। আর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাটি এসেছিল ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে।
পৃথিবীর অনেক রাষ্টবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক ৭ই মার্চের ভাষণকে নিয়ে করেছেন বহুমাত্রিক আলোচনা। বিশেষত দু’টি ভাষণের সঙ্গে তারা তুলনা করে থাকেন, যার একটি ১৮৬৩ সালের আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’; তবে ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত, ২৭২ শব্দের, দুই মিনিটের, ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে। অপরটি ১৯৬৩ সালের মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ অ্য ড্রিম’, ভাষণটির প্রথমাংশ লিখিত ও পঠিত যা ১৬৬৬ শব্দের, ১৭ মিনিটব্যাপী, শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ।
এছাড়াও অনেকের গবেষণায় তৎকালীন সমসাময়িক আরও দুটো ভাষণ তুলনায় উঠে এসেছে। ১৯৪০ সালের উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’, ভাষণটি ৩৭৬৮ শব্দের ১২ মিনিট ১৬ সেকেন্ডব্যাপী যা শুধু আইনসভার ৬০০ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালের জওহরলাল নেহেরুর ‘অ্যা ট্রাইস্ট উইথ ডেস্টিনি’, ভাষণটি ৭৫৫ শব্দের পাঁচ মিনিট নয় সেকেন্ডব্যাপী সেটিও সংবিধান পরিষদের ৫০০ মানুষের সামনে দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক, স্বস্তঃস্ফূর্ত ও অলিখিত।
ভাষণটি শব্দ-বুলেটের মালা গেঁথে ‘জয় বাংলা’স্লোগান দিয়ে শেষ করেন। ১০ লক্ষাধিক বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সামনে পাকিস্তানি হানাদারদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে বক্তব্য প্রদান করেন। ভাষণটি ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস থেকে, বাংলার জনগণের প্রতি তাঁর বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ক্ষমতাবান সরকারসমূহ ও বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’
অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, “তিনি ছিলেন মানব জাতির পদ প্রদর্শক। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয় সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।’’ পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, “৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।’
গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
রয়টার্স -এর মতে “বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।’’ এএফপি বলেছে, “৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’
দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯৭১-এর এক ভাষ্যে বলা হয়, “শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’’ ʻআনন্দবাজার পত্রিকা’ ১৯৭২ এক নিবন্ধে বলা হয়, “উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’
সম্প্রতি ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ʻমেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ সারা পৃথিবীতে এতবার প্রচারিত ও শ্রুত হয়নি। ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস অপর নগররাষ্ট্র স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত স্বদেশীয় সৈন্য ও সাধারণ মানুষের স্মরণে যে ভাষণ দেন (৪৩১ খ্রি. পূর্ব) তা থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান-এর ১৯৮৭ সালে বার্লিনে দুই জার্মানির মধ্যকার বিভক্তির দেয়াল (বার্লিন ওয়াল) ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করার আহ্বান সম্বলিত ভাষণ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন জাতীয় বীর ও সমরনায়কের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ʻJacob F Field, We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ স্থান পেয়েছে। শ্রেষ্ঠ ভাষণের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি কী তার আলোকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়। এক, যে-কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণ মাত্রই তা প্রচণ্ড উদ্দীপনীয় (Inspiring) : মুহূর্তে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তুলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুত করতে পারঙ্গম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মূল ও আশু লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসনশোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতা- ʻএবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুধু লক্ষ্য ঘোষণা করেই বঙ্গবন্ধু নিবৃত থাকেন নি, তিনি স্বাধীনতার সে লক্ষ্য অর্জনে আসন্ন যুদ্ধের বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালিদের দিকনির্দেশনাও দান করেন, ʻ… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি। তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে দেওয়া ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের ইতিহাস, ভূগোল, মানচিত্র পাল্টে দিয়েছিল। তাই এই ভাষণ আজ বিশ্বের সম্পদ। এই ভাষণ আজ বিশ্বের ‘Memory of the world Register’ – এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কালজয়ী এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে চিরকাল প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ছিনিয়ে আনি মহান স্বাধীনতা, বাঙালি জাতি পায় মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ। প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ৭ মার্চের অমর বাণী স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালির নানা সংকটে, সংগ্রামে জাতিকে বার বার পথ দেখিয়েছে। সাহস জুগিয়েছে নবতর স্বপ্নে বুক বেঁধে পথ চলার। বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী বাণী দূর করে দেয় সকল বিভ্রান্তি আর আপসের ষড়যন্ত্র। তাই এই ভাষণ বিশ্বের সর্বাধিকবার প্রচারিত ও শ্রবণকৃত অলিখিত ভাষণ। সহস্র যুগেও বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের এই ভাষণের আবেদন ও প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরাবে না।
লেখক: দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
Discussion about this post