অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন
করোনার নেতিবাচক প্রভাবে দীর্ঘ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। এক ধরনের অস্থিরতা, অসহিষুষ্ণতা, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, পারস্পরিক সম্পর্কের দূরত্ব, সন্দেহপ্রবণতা সর্বোপরি হতাশা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করেছে। আর এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে। যেমন- সামান্য ঘটনায় তাদের মধ্যে অস্থিরতা, অসহিষুষ্ণতা প্রকাশ, রাগ-ক্ষোভ নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া, অন্যের প্রতি সন্দেহ বেড়ে যাওয়াসহ অনেক ধরনের আচরণ। ফলে অল্পতেই মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ, ভাঙচুর, অস্থিরতা, খারাপ ব্যবহার, নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন মনোরোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তেমনি প্রত্যেক শিক্ষকের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ বক্তৃতা দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকরা একাডেমিক কমিটিতে আলোচনা করে যদি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেন তাহলে সেটা হবে যথার্থ ও কার্যকরী। এ ছাড়া প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টরসহ প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যবস্থা নিলে শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকরা নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের যদি উদ্বুদ্ধ করেন, তা খুব কার্যকরী হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষকদের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এ কথা ঠিক, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে আলাদা করে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই; দু-একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া। সে ক্ষেত্রে নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষকরা যদি তাদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মোটিভেশনাল বক্তব্য দেন এবং শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলেন সেটাও হবে কার্যকরী। আরেকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। তা হলো নবীন শিক্ষার্থী যারা ক্লাস শুরু করেছে, তাদের ‘র্যাগিং’ তথা ‘নিপীড়ন’ থেকে মুক্ত রাখা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন, প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টার সমন্বয়ে কঠোর নজরদারি এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি রাখতে হবে। মোট কথা, নবীন শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সব রকম ভয়-শঙ্কা দূর করে আস্থা ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে কঠোর হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না- বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা, গতিশীলতা নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিক-মানসিক স্বস্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করার মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। যেমন- শিক্ষার পরিবেশ অনুকূলে ও গতিশীল রাখতে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের মাধ্যমে, অর্থাৎ ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠন সেটা ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক নেতা ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা মিলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহযোগিতায় মানসিক স্বাস্থ্য মেডিকেল সেন্টারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আশপাশের প্রতিষ্ঠানিক নেতৃবৃন্দসহ অপ্রতিষ্ঠানিক নেতাদের মধ্যে সমন্বয় করে তাদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাণভোমরা’ হলো শিক্ষার্থী। তাই শিক্ষার্থীদের সুস্থ মানসিকতাসহ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা অতীব গুরুত্ববহ।
এর ইতিবাচক ফল ও প্রভাব শিক্ষার্থীর মনে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারবে বলে প্রতীয়মান। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে আর অবহেলা নয়; প্রয়োজন নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্রিয় উদ্যোগ। তা যত দ্রুত হবে ততই সার্বিক মঙ্গল। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমকে জোরদার করতে সহশিক্ষার নানা শাখায় প্রতিযোগিতামূলক আয়োজনের উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, গণিত অলিম্পিয়াড, সমসাময়িক বিষয়ে কুইজসহ ছোট ছোট সামাজিক কার্যক্রমের উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানে থাকবে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা। এই আগ্রহ সৃষ্টি করতে প্রয়োজন উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম, যা বাস্তবায়িত হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমে।
প্রায় প্রতিটি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগেই নানা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে থাকে। তাদের এ প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করতে দরকার সংশ্নিষ্ট শিক্ষক তথা প্রশাসনের সঠিক ও গঠনমূলক নির্দেশনা।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় গঠনমূলক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে সমগ্র শিক্ষা কার্যক্রম তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক প্রভাব অবধারিত। মূলত এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা, যা বাস্তবায়িত হবে সংশ্নিষ্ট সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের মনোবল বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাস তৈরি, হতাশা থেকে উত্তরণ তথা সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটানো। বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের করোনা-পরবর্তী সময়ে উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধন করতেই হবে।
লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post