কায়সুল খান
বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণের পর শব্দদূষণের তালিকায়ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘বার্ষিক ফ্রন্টিয়ার্স রিপোর্ট-২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে শব্দদূষণে ঢাকা শহরের শীর্ষস্থানে উঠে আসার তথ্যটি উঠে আসে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ইউএনএপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শব্দদূষণে পৃথিবীর শীর্ষ শহর এখন ঢাকা।
শব্দদূষণের এই তালিকায় শীর্ষ পাঁচে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পরের নামগুলো যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ, বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী এবং ভিয়েতনামের শহর হো চি মিন সিটি। বাংলাদেশ ছাড়াও শব্দদূষণের এ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতের বিভিন্ন শহরের নাম এসেছে। এর মধ্যে কলকাতা, দিল্লি, জয়পুর ও আসানসোলের নাম উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দসীমার মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ও যানজটপূর্ণ এলাকায় এই মাত্রা ৭০ ডেসিবেল। ইউএনএপি’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণ ও যানজটের শহর রাজধানী ঢাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল এবং রাজশাহীতে ১০৯ ডেসিবেল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ উপর্যুক্ত প্রতিবেদনের তালিকায় থাকা বাংলাদেশের দুটি শহরেই শব্দদূষণের সীমা অতিক্রম করে গেছে। শব্দদূষণের শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের দুটি শহরের অবস্থান থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে শব্দদূষণ কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে শব্দদূষণের প্রধান কারণ হিসেবে পরিবেশগত বিভিন্ন শব্দের নানা উৎস, যানজট, বিমান চলাচল, রেল চলাচল, শিল্পের নানা যন্ত্রপাতি এবং ধর্মীয় ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের নাম উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে শব্দদূষণের ব্যাপারে অসচেতনতা, শব্দদূষণের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে অজ্ঞতা এবং আইনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়ার কারণে এখানে প্রতিনিয়ত দূষণ বেড়ে চলেছে। রাস্তাঘাটে গাড়ির হর্নের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, শিল্প প্রতিষ্ঠানে শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ ও অনুষ্ঠানস্থলে শব্দসীমা অতিক্রম করে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার বাংলাদেশে নিত্যদিনের ঘটনা।
সারা বিশ্বে শব্দদূষণের ব্যাপারে কড়াকড়ি থাকলেও ঢাকা তথা বাংলাদেশে আইনের বিশেষ প্রয়োগ নেই। সরকার হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র এলাকায় শব্দসীমা বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু শব্দদূষণ রোধে সরকারি নির্দেশনা প্রায় কেউই মানে না। বস্তুত সেনানিবাস ছাড়া রাজধানী ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোথাও কোনো হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশ দিয়ে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে গাড়ি গেলে তা তদারক করার কেউ নেই।
গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাইক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেম, শিল্পকারখানায় অতিমাত্রায় শব্দদূষণের ফলে সমাজে বধিরতা বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া নানান শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার কারণও শব্দদূষণ। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ শ্রবণজনীত জটিলতার শিকার। চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দদূষণের ফলে মানুষের শ্রবণক্ষমতা কমা ছাড়াও হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী শব্দদূষণের শাস্তি হিসেবে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে এই বিধিমালায় এ ধর্মীয় ও বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে আইনের কিছুটা শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এ সমস্ত ক্ষেত্রে শব্দদূষণ ঘটছে। দেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অভাব রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের আইনে এর শাস্তি উন্নত বিশ্বের তুলনায় যথেষ্ট অপ্রতুল। অন্যদিকে জনসাধারণের মাঝে দেশের প্রচলিত আইন মানতে অনীহা লক্ষণীয়। ফলে নাগরিক হিসেবে শব্দদূষণজনীত অসুবিধা থেকে রেহাই পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে ঢাকা তথা সমগ্র দেশবাসী।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষজ্ঞরা বারবার আমাদের শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ঢাকা শহরের সর্বত্রই শব্দদূষণের মাত্রা সীমা অতিক্রম করে গেছে। বস্তুত সমগ্র বাংলাদেশেই কম-বেশি শব্দদূষণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি হচ্ছে। ফলে শিশু, বয়স্ক ও রোগীদের পাশাপাশি সব বয়সী মানুষ দূষণের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিত শব্দদূষণের কারণে নানাবিধ রোগের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অসুস্থ হয়ে গড়ে উঠছে। উচ্চশব্দ শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মা ও হৃদরোগীদের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। তাছাড়া এই দূষণের ফলে মানুষের মাঝে মাথাব্যথা, বদহজম, অনিদ্রা ও মনসংযোগহীনতার মতো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে সাধারণ নাগরিকদের মাঝে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে বিশেষ ধারণা নেই। ঢাকা শহরসহ সমগ্র দেশে শব্দদূষণের মাত্রা গ্রহণযোগ্য সীমা অতিক্রম করে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার প্রয়াসের অভাব লক্ষণীয়। পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ না থাকায় জনসাধারণও সুনাগরিকের মতো আচরণ করছে না। ঢাকা শহরে শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম গাড়ির হর্ন। অথচ দেশের অধিকাংশ গাড়ির চালক শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। অন্যদিকে কলকারখানার যন্ত্রসৃষ্ট শব্দ নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। এছাড়া সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাবেশে শব্দদূষণ হলেও বিষয়টি বন্ধ করা স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে এসব ক্ষেত্র থেকে সৃষ্ট দূষণ বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকা তথা উন্নত দেশে শব্দদূষণ আইন জরুরি সেবা ছাড়া সকল ক্ষেত্রে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। ফলে সেসব দেশের মানুষ শব্দসীমা মেনে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় কর্মকাণ্ড চালায়। আধুনিক বিশ্বে শব্দদূষণকে গুরুতরভাবে বিবেচনা করা হয়। শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে তা নিয়ন্ত্রণকল্পে বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বকে অনুসরণের সময় হয়েছে।
শব্দদূষণ কেবল শারীরিক-মানসিকভাবেই মানুষকে ক্ষতি করছে না বরং এর অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। এর ফলে একদিকে সমাজের মানুষের যেমন চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। আবার শব্দদূষণের কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ, কঠোর আইন প্রণয়ন ও জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আমরা আশা করি, বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া সাপেক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
লেখক-কায়সুল খান,প্রবাসী শিক্ষার্থী
Discussion about this post