ড. জেবউননেছা
সম্প্রতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের জীবন নিয়ে ‘বেদনাতুর ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫’ নামক গবেষণার অংশ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের ছিলেন যারা, তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন, তাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু করেছি। সেই সূত্র ধরে বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণও করেছি। গবেষণার অংশ হিসেবে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘ইতিহাসের রক্ত পলাশ: পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করি। ২১৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি পড়ে মনে হলো, আমি যদি ‘ইতিহাসের রক্ত পলাশ: পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর’ গ্রন্থটি নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম তাহলে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। সেই ইচ্ছে থেকে বেশ কয়েকজনকে মুঠোফোনে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের কাছে গাফ্ফার চৌধুরী স্যারের ফোন নম্বর আছে কিনা। কেউ দিতে পারলেন না। আমি হতাশ হয়ে যাই, আবার আশায় বুক বাঁধি। একসময় পেয়ে যাই। যিনি নম্বরটি দিলেন, তিনি বললেন, রাতের দিকে ফোন করলে পাওয়া যাবে। উনি আমার কথা গাফ্ফার চৌধুরী স্যারকে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে একজন ফোন করবে। আমি তো নম্বর পেয়ে অস্থির হয়ে যাই কখন কথা বলবো।
ছেলেবেলা থেকে একুশের যে গানটি শুনে বড় হলাম, সেই গানটির রচয়িতার সঙ্গে কথা বলতে পারবো, বিষয়টি স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। রাতে আমি ফোন দিলাম। ফোনে আমার গবেষণার বিষয়বস্তু জানালাম। তিনি বললেন, আমি তোমাকে সাক্ষাৎকার দেবো। এরপর প্রথম দিন একঘণ্টা কথা বললেন। স্মৃতি রোমন্থন করলেন। তিনি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনেছিলেন। তখন থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে ভক্ত হয়ে যান। তখন বরিশালে ‘নকীব’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল, নূর আহমেদ সম্পাদিত। তিনি সেই পত্রিকায় লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে তিনি তাঁর লেখা দেখান বরিশালের চলন্তিকা রেস্তোরাঁয়। বঙ্গবন্ধু তার লেখা পড়ে বলেন, ঢাকায় আসো, ঢাকায় এসে তারপর দেখা করো। ১৯৫০ সালে ঢাকায় আসেন। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ছিল তখন সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা অফিসে বঙ্গবন্ধু আসতেন, সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখা শুরু করতে বলেন। পরে মুজিবনগর সরকারের পত্রিকা ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হন। একসময় বঙ্গবন্ধু তার জীবন নিয়ে বলতেন, গাফ্ফার চৌধুরী লিখতেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই ডায়েরিটি তিনি হারিয়ে ফেলেন। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে তাকে ‘বারতা চৌধুরী’ বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ এবং নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পছন্দ করতেন এমন আরও অনেক স্মৃতি তিনি বয়ান করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ব্রিটেনে প্রগতিশীল বাঙালিরা বাংলাদেশে সামরিক-ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে ‘বাংলার ডাক’ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হওয়া শুরু হয়। ওই পত্রিকায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘মুজিব হত্যার নেপথ্যে’ নামে একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ লেখা শুরু করেন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক কোনটি? তিনি বলেছিলেন, ‘প্রচণ্ড সাহস। কাউকে ভয় পেতেন না। দুর্বল দিক ছিল, কেউ যদি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে ভুল করে ক্ষমা চাইতো, বঙ্গবন্ধু তাকে মাফ করে দিতেন। খুনি মোশতাককে বঙ্গবন্ধু তাঁর উদারতা দিয়ে বারবার ক্ষমা করায় বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েছেন।’ ৫৬, আগামসিহ লেনে খন্দকার মোশতাকের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার নীলনকশা এক দরিদ্র মেয়ে প্রকাশ করে দেওয়ায় পরবর্তীকালে তাকে তারা মেরে ফেলে, এই কথাটি আমাকে বলেন। এই মেয়েটি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এই বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্মরণিকাতে গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন একজন সদস্য। এই স্মরণিকা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম, স্যার ‘বাংলাদেশ’ নামক স্মরণিকায় আপনি কাজ করেছেন, সে সময়কার স্মৃতি বলুন। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এই স্মরণিকা প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার একুশের গান কোন পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ রফিকের লাশ দেখে একটি কবিতা লিখেছিলাম, সেই কবিতাটিতে আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়েছেন’।
স্যার, বাংলাদেশ নিয়ে আপনি কী স্বপ্ন দেখেন? তিনি বলেছিলেন, ‘জনসাধারণের সকল স্তরে সমান আয়, ব্যয়ের তারতম্য কম হবে। তাহলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’ এমন আরও অনেক কথা হতো স্যারের সঙ্গে।
একদিন সকাল ১১টার দিকে স্যার নিজেই আমাকে ফোন করে জানতে চান, কী ব্যাপার কয়দিন ধরে ফোন দিচ্ছো না। ব্যস্ত খুব? আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার গবেষণা নিয়ে একটু ছুটোছুটির মধ্যে আছি। দুঃখিত স্যার’। বললাম, স্যার আমি তো আপনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পারবো না। আপনি বিদেশে আছেন। আপনাকে স্যার আমি ভিডিও কলে দেখতে চাই। তিনি রাজি হলেন। অনুমতি নিয়ে একটি ছবি তুলে রাখলাম। কে জানতো ওই ছবিটিই হবে আমার সঙ্গে গাফ্ফার চৌধুরীর শেষ ছবি। প্রায় সময় তাঁকে ফোন দিতাম। কোনও কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতাম। সংশোধন করে দিতেন, দরকার হলে সংযোজন করে দিতেন।
একসময় বললাম, স্যার আপনি একজন গুণী মানুষ। আমার সম্পর্কে যদি এক লাইন লিখে দিতেন, তাহলে কৃতার্থ হবো। জানালেন, লেখা দিতে সময় লাগবে। তোমাকে আরও জানতে হবে। তোমার কাজ সম্পর্কে জানতে হবে। তারপর হয়তো লিখতে পারবো। একসময় স্যার আমার সম্পর্কে একদিন পুরো তথ্য সংগ্রহ করলেন, জানতে চাইলেন বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আর কোন বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আমি বললাম, আমার বাবা নিয়মিত দিনলিপি লিখতেন ১৯৬৯ সাল থেকে। ১৯৭১-এ তাঁর দিনলিপিতে আমি অনেক অজানা তথ্য পেয়েছি। সে দিনলিপি নিয়ে কাজ করছি। বইটির নাম হবে, ১৯৭১-এর কলমসৈনিক মু. জালাল উদ্দিন নলুয়ার দিনলিপি’।
শুনে বললেন, বাহ দারুণ তো। তখন মাঝে মাঝে দিনলিপি পড়ে শোনাতাম। একদিন বললেন, আমি তোমাকে এই গ্রন্থ সম্পর্কেই মুখবন্ধ দিবো। আমি তো বিস্মিত হয়ে যাই, আমার গ্রন্থে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মন্তব্য দেবেন এই ভেবে। পরের দিন ২৬-০৩-২০২২ইং তারিখে ফোন করলেন। ফোনে বললেন, খাতা কলম নাও, লিখো। তিনি বলে যাচ্ছেন আমি লিখে গেছি।
এভাবেই স্যারের সঙ্গে আমার স্নেহের সম্পর্ক এগিয়ে যায়। একদিন ফোন দিলে জানালেন তাঁর মেয়ে অসুস্থ। তাই মনটা খারাপ। আর একদিন ফোন দিলাম, জানালেন তিনি অসুস্থ। আমি বললাম, স্যার শরীরটার যত্ন নেবেন। আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে। স্যার কিছু বলেন না, চুপ করে থাকেন।
দেশপ্রেমিক সচেতন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো প্রাবন্ধিকের মৃত্যুতে দেশ একটি সম্পদ হারালো। এমন সম্পদ ফিরবে কিনা এটা বলা কঠিন। মানুষ মরে গেলে ইতিহাস হয়। অথচ তিনি ছিলেন জীবন্ত ইতিহাস। তিনি তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, ‘অষ্টাদশ শতকের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বিংশ শতকের বাংলাদেশে। এবার বাণ্যিজ্যের নামে নয়, সাহায্যের দানছত্র নিয়ে এসেছিল বিদেশিরা। তারপর রাত পোহাতে না পোহাতে দেখা গেলো, সাহায্য নয়, তা ষড়যন্ত্র। আবার সেই ষড়যন্ত্রের প্রথম বলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক শেখ মুজিব।’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো বুদ্ধিজীবী দেশপ্রেমিক মানুষ কালেভদ্রে দেখা যায়। ১৯৭২ সালে তিনি ‘দৈনিক জনপদ’ প্রকাশ করেন। সে পত্রিকায় বাল্যকালে ০৮-০৫-১৯৯০ সালে ‘শাপলা দোয়েল’ পাতায় ‘মুক্তো মানিক হীরা’ শীর্ষক কলামে আমার সচিত্র প্রতিবেদন শিশুশিল্পী হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। পরিণত বয়সে এসে সম্পাদিত গ্রন্থে মুখবন্ধ দিলেন, এটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের। একজন গীতিকার, লেখক, প্রাবন্ধিক ব্যক্তিজীবনে তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছেন অনেক আগে। কয়দিন আগে হারালেন তার মেয়েকে। এবার তিনি হারিয়ে গেলেন। এভাবেই মানুষ হারিয়ে যায়। থেকে যায় তাঁর সৃষ্টিকর্ম। আজ সামাজিক মাধ্যমে সব জায়গায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্যারের ছবি ভাসছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এসেছে তার জীবনকর্মের খতিয়ান। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি ঠিকই আসবে। তাঁর লেখা গানটি বাজবে সব স্থানে। অথচ তিনি ফিরবেন না।
প্রতিবছর ১৯ মে আসবে, কিন্তু তিনি ফিরবেন না। নব্বই দশকে ‘রূপান্তরের গান’ শিরোনামে একটি অ্যালবামে কণ্ঠ দিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শাহীন সামাদ ও এনামুল হক। রূপান্তরের গানের শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক আমাকে গাফ্ফার চৌধুরী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, তিনি ১৯৭১-এ শরণার্থী কার্ড নিয়ে যখন ভারতে প্রবেশ করেন তখন একই সময়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও একসাথে ভারতে যান। নব্বই দশকের শেষের দিকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দেশের বাইরে থেকে যখন ঢাকা আসতেন তখন তিনি প্রায়শই ঢাকা ক্লাবে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বন্ধুদের মধ্যে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আমিনুল হক বাদশা, রফিকুননবী, মাহমুদুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, এনামুল হক প্রমুখ আলোচনায় থাকতেন। এ সময় সবাই মিলে দেশের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। দেশ কী করে এগিয়ে যাবে সে বিষয়ে কথা বলতেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্বপ্ন দেখতেন দেশের প্রতিটি তরুণ হবে এক একটি বাংলাদেশ। যারা দেশটিকে এগিয়ে নেবে সুন্দরের পথে। সঠিক ইতিহাস অনুসন্ধান করবে। কী করে দেশটি আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু যে অবিচ্ছেদ্য অংশ, এ বিষয়ে জানার জন্য তিনি তরুণদের আরও বেশি অধ্যয়ন করার বিষয়েও ভেবেছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। সেই মনোভাবের পরিচয়ও সেই আলোচনায় লক্ষ করা যেতো। একজন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক এবং প্রাবন্ধিকের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তাঁর এই প্রয়াণে কবি ও নাট্যকার মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া আবদুল গাফফার চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাৎক্ষণিক যে কবিতাটি লিখেছেন, সে কবিতা দিয়েই শেষ করবো আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্মরণে লেখাটি। ‘একুশ আসে কাঁদাতে আরবার/একুশের গানে যিনি রাহবার/তাঁর স্মৃতি জাগে বারবার/ তিনি প্রাবন্ধিক, গীতিকার গাফ্ফার স্যার’।
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post