সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে কীভাবে এগোবে? কেবল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগোনো সম্ভব নয়। কেননা সমাজ থেকে তাকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সমাজের বৈষম্য ও হতাশা তার ওপরে এসে পড়বেই, এখন যেমন পড়ছে এবং তাকে স্থবির করে দেবে, যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
ছিলাম তখন সামন্তবাদে। পঞ্চাশের দশকে অত্যন্ত ছোট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রী তিন হাজারও হবে না। শিক্ষক হতে পারেন বড়জোর দেড় শ। প্রায় সবাই চিনত সবাইকে। অনুগত ছিল ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রতি। সিগারেট খেত কেউ কেউ, কিন্তু শিক্ষককে দেখলে লুকিয়ে ফেলত। ‘বেয়াদবি’ তখনো গুণ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি, যদিও একেবারে ছিল না যে তা নয়। মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো হল ছিল না, একটি হোস্টেল ছিল, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সংখ্যা পাঁচ শ তখনো ছাড়ায়নি, অনুমান করি। ক্যাম্পাসে কোনো মোটরগাড়ি চোখে পড়েনি। পড়ত না। ওই সামান্য অবস্থাটাকে চিরস্থায়ী হতে আমরা দিইনি। তাকে ভেঙে এগিয়ে গেছি। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দশ গুণ বেড়েছে, শিক্ষকসংখ্যাও সেই অনুপাতে। কী নাম দেব এই উত্তরণের? বলতে পারি, চলে এসেছি গণতন্ত্রের যুগে।
গণতন্ত্রের যুগে এ কথা বলাটা সংগত হবে। কিন্তু উত্তরণ এমনি এমনি ঘটেনি। তার জন্য রীতিমতো আন্দোলন করতে হয়েছে। দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সামনে। সবার সামনে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু, তার প্রবাহে ছাত্র যেমন গ্রেপ্তার হয়েছে, তেমনি শিক্ষকও। রাষ্ট্র ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন ইংরেজ আমলে যেটুকু ছিল, সেটুকুও খর্ব করা হয়েছিল কালো আইনের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে সরকারি দপ্তরে।
ধাপে ধাপে এগিয়েছে আন্দোলন। লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আঘাতে আঘাতে দুর্বল হয়েছে প্রতিপক্ষ। শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে রাষ্ট্র। নতুন সংবিধান এসেছে দেশে এবং স্বায়ত্তশাসন পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার এই যোগটা কাকতালীয় নয়, একেবারে অঙ্গাঙ্গি।
তবে এই যে উত্তরণ, এতেও সন্তুষ্ট নয় মানুষ। এর একটা কারণ—বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশাটা বেশি। আরেকটা কারণ, ধারণা করা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের মান আগের তুলনায় নেমে গেছে। অভিযোগটা কি সত্য? আংশিকভাবেই সত্য শুধু। সবাই না হলেও শিক্ষকেরা যে এখন আগের তুলনায় কম জানেন কিংবা অল্প পড়াশোনা করেন, তা নয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও কেউ কেউ আগের কালের তুলনায় বরং অধিক অগ্রসর।
কিন্তু সবাই নয়। আগের দিনে শিক্ষকেরা পরিবেশ যেটা পেতেন, সেটা ছিল ভিন্নতর। একাগ্র হওয়ার চমৎকার সুযোগ ছিল, অন্য সব দীনতার মধ্যেও। বাইরের চাপ ছিল কম। প্রথম যুগে তো অনেকেই ঢাকায় এসেছিলেন মফস্বলে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন মনে করে। এখানে এসে অন্যদিকে টান ছিল না, দায়দায়িত্ব ছিল অল্প, তাঁরা নিবিষ্ট মনে জ্ঞানের সাধনা করতে পারতেন। গণতন্ত্রের যুগে দৃষ্টি নানা দিকে যায়। টান আসে বিভিন্ন রকমের। জ্ঞানচর্চার দাম পাওয়া সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে। তাই বলে শিক্ষকদের কারণে শিক্ষার মান যে নেমে গেছে, তা সত্য নয়। শিক্ষকদের গবেষণা-প্রকাশনা ঠিকই চলছে।
ছাত্রদের মানও ঢালাওভাবে অবনত হয়নি। ওই যে বললাম কিছু ছেলেমেয়ে আগের ছেলেমেয়েদের তুলনায় বরং বেশি জানে, সেটা ঠিক। তবে তাদের সংখ্যা কম। এটা এখন ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন আর গড়পড়তা শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই। কয়েকজন খুব ভালো, বাকিরা তেমন ভালো নয়। বাকিরা যে ভালো করে না, তার কারণ একাধিক। সমাজ বৈষম্যময়, সেই বৈষম্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনেও প্রতিফলিত। অনিবার্যভাবে। আগের তুলনায় বৈষম্য কমেনি, বরং বেড়েছে। সেই সত্য লিখিত আছে সর্বত্র। রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষাজীবনেও। দ্বিতীয় কারণ, শিক্ষার দাম পড়ে যাওয়া। এখন বেকারত্বের অন্ধকার এত বেড়েছে যে শিক্ষার্থীরা আশার আলো পায় না, এই ভরসা থাকে না যে শিক্ষা তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা দেবে। বর্ষে বর্ষে তাই আগ্রহ কমে আসে জ্ঞানান্বেষণে। ছেলেমেয়েদের অনেকেই যান্ত্রিকভাবে আসে এবং যায়। আগে এমনটা ছিল না। আগে চাকরি যা হোক একটা পাওয়া যাবে—এমনটা আশা করা যেত। সুযোগ বাড়বে আশা করেই গণতন্ত্র চাওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র এসেছে বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু সুযোগ যে বাড়েনি এবং বৈষম্য যে বেড়েছে, এ একেবারেই নিঃসংশয় সত্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে সন্ত্রাস আছে। ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক জীবন বলতে কিছু নেই। ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হয় না। পরিবেশ অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর, সন্দেহ নেই। আসলে গণতন্ত্র তেমন নেই। রাষ্ট্রে নেই, সমাজেও অনুপস্থিত। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। গণতন্ত্র আনুষ্ঠানিকতায় আছে, প্রাণে নেই। আগের দিনে ভাবা হতো যে বিশ্ববিদ্যালয় যাবে সামনে এগিয়ে, পেছনে পেছনে ছাত্ররাই শুরু করেছে অতীতের বড় বড় আন্দোলন। অসন্তুষ্ট ছিল মানুষ, অস্থির ছিল সামন্তবাদ ভাঙবে বলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দখল করতে চেয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতাকে। কিন্তু গণতন্ত্র যখন অনুষ্ঠান করে এল, কিন্তু আসলে এল না, সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কী করবে? এগোবে কোন পথে?
এখন বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের তুলনায় এগিয়ে নেই, যেমন আগে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এখন সমাজের অধীনে চলে গেছে। তার কারণ এখন আর আগের মতো আন্দোলন নেই। গণতন্ত্রের পরে আন্দোলন হবে কোন লক্ষ্যে? মনে করা হয়েছিল, তবে তা সমাজতন্ত্রের জন্য। তত্ত্বগতভাবে সমাজতন্ত্রেই শুধু গণতন্ত্র সম্ভব, প্রকৃত অর্থে। অতদূর না হয় না-ই গেলাম। এটা তো সত্য যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনই সমাজতন্ত্রের অভিমুখী আন্দোলন। সেটা এখন দেশে নেই। যেটুকু ছিল স্তিমিত হয়ে এসেছে। এখনকার চেষ্টা ক্ষমতা দখলের ঠিকই, কিন্তু সমগ্র জনগণের জন্য নয়, নিজ নিজ দলের জন্য। সমগ্র জনগণের আন্দোলন চরম উৎকর্ষে পৌঁছে ছিল মুক্তিযুদ্ধে; তার পরে থেমে গেছে; এখন তা একেবারেই নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে কীভাবে এগোবে? কেবল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগোনো সম্ভব নয়। কেননা, সমাজ থেকে তাকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সমাজের বৈষম্য ও হতাশা তার ওপরে এসে পড়বেই, এখন যেমন পড়ছে এবং তাকে স্থবির করে দেবে, যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তাকে তাই সমাজে পরিবর্তনের আন্দোলনে যোগ দিতে হবে, যেমন অতীতে সে দিয়েছে। অতীতে সমাজকে সে যে শুধু দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ করেছে তা তো নয়, আন্দোলনের সূত্রপাতও সরবরাহ করেছে বৈকি। সেভাবেই, ওই দুই অভিপ্রায়কে একত্র করেই, সে প্রাণবন্ত ও মর্যাদাবান হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের যুগে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করা এবং তাকে গড়ে তোলার সঙ্গে এ দেশের ভবিষ্যৎ যে জড়িত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়কেও ওই মীমাংসায় ও সংগঠনে অংশ নিতে হবে। লক্ষ্যহীন ও হতাশ অবস্থায় কেউ এগোতে পারে না, বিশ্ববিদ্যালয় তো নয়ই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post