ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার
বিশ্বজুড়ে সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ অপচয়ের একটি অন্যতম কারণ আত্মহত্যা। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, বিশ্বযুদ্ধ-দাঙ্গা এমন সহিংসতায় যত মানুষের প্রাণহানি ঘটে তার চাইতে বেশি প্রাণহানি ঘটে আত্মহত্যার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। আত্মহত্যা প্রচেষ্টা করেছেন এমন মানুষদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি তারা সবাই মরে যেতে চান– তা নয়।
দুটো বিষয় এখানে ভূমিকা রাখে– প্রথমত, ব্যক্তি দেখতে পান যে তিনি এমন একটি অসুবিধার মুখোমুখি রয়েছেন যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, তিনি মনে করেন এই অসুবিধা নিয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন। সুতরাং আত্মহত্যা তার কাছে জীবনের এই অসুবিধা থেকে সরে যাওয়ার একটি পদ্ধতি মাত্র।
ব্যক্তিকে যদি দেখতে বা খুঁজে পেতে সাহায্য করা যায়– জীবনের অসুবিধাটি সমাধানের বা সেটির প্রভাবগুলোর সাথে মানিয়ে চলার কোনও পথ আছে; তাহলে ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে সরে আসেন।
আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বেশিরভাগ মানুষই বাহ্যিক বিষয়গুলো দেখতে পান। এমনকি পত্রিকার রিপোর্টেও আমরা তেমনটাই দেখতে পাই– পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, আব্দার পূরণ না হওয়া, সম্পর্কের জটিলতা ইত্যাদি। তবে আত্মহত্যা চেষ্টার মূল কারণ এগুলো নয় বরং একজন ব্যক্তি এই বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখেন বা অনুভব করেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলো থেকে প্রতিটি মানুষের নিজস্ব চিন্তা, আবেগ ও আচরণের ধরন তৈরি হয়। যে কারণে একই ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যে শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকে দেখে বা শিখে এসেছে পরীক্ষায় ফলাফলের ওপরই নির্ভর করে তাকে কতটা ভালোবাসা হবে বা মূল্য দেওয়া হবে। তার কাছে ‘খারাপ ফলাফল’ যে অর্থ বহন করে, অন্য আরেকজন যে শিখে এসেছে পড়াশোনার তেমন মূল্য বা গুরুত্ব নেই। ‘খারাপ রেজাল্ট’ কিন্তু তাঁর কাছে একেবারেই ভিন্ন অর্থ বহন করবে।
মা যখন আমার আব্দার পূরণ না করেন এর অর্থ কারও কাছে হয়তো ‘মা আমাকে ভালোবাসে না’ বা ‘আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই’। স্বাভাবিকভাবেই এই ভাবনাগুলো ব্যক্তিকে তীব্র কষ্টের মধ্যে ফেলবে। এই তীব্র কষ্ট ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনাকে যখন আচ্ছন্ন করে দেয়, সারাক্ষণ এই একই ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে এবং ব্যক্তি ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোর দিকে মন দিতে পারেন না। কারও কারও ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন মনে হয়।
আত্মহত্যা চেষ্টার পেছনে একটি বড় ভূমিকা রাখে আশাহীনতা। আশা আমাদের জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা স্বপ্ন দেখি এবং সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে ভালো থাকার আশা করি। কখনও কখনও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বা বার বার আশাহত হওয়ার অভিজ্ঞতা ব্যক্তির মধ্যে তীব্র আশাহীনতার অনুভূতি তৈরি করে। এই আশাহীনতার অনুভূতি নিয়ে জীবন চালিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক দক্ষতা অনেকেরই থাকে না। এমন ক্ষেত্রে কোনও কোনও মানুষ জীবন-বিমুখ অনুভব করতে পারেন। বিশেষ করে যারা বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তাদের মধ্যে আশাহীনতার বিষয়টি বেশি দেখা যায়।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা ব্যক্তির কষ্টের কথা এবং সংশ্লিষ্ট মনের ভাবনাগুলো শুনি। তাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করি– কীভাবে তিনি তার কষ্টগুলো কমাতে বা সমাধান করতে পারেন। সর্বোপরি ব্যক্তির মানসিক দক্ষতা উন্নয়নে সাহায্য করি যাতে তিনি পরবর্তী পরিস্থিতিগুলোতে একইভাবে সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র তার আত্মহত্যা প্রবণতাকেই দূর করে তা নয়; বরং তাকে সামগ্রিকভাবে মানসিক প্রশান্তি অর্জনের দিকে নিয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের একটি গবেষণায় রুবিনা জাহান খুঁজে বের করেছেন– আত্মহত্যা পূর্ববর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ যা দেখে ব্যক্তির কাছের মানুষরা তার আত্মহত্যার ঝুঁকি অনুমান করতে পারবেন। যদিও এই লক্ষণগুলো থাকার মানে এই নয় যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবেনই, তবে এই সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে কেবলমাত্র ব্যক্তিকে নিয়ে কাজ করাটাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সামগ্রিক পদক্ষেপ নেওয়া।
সারা বিশ্ব যেখানে উন্নয়নের মাপকাঠিতে অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেই বিচার্য হিসেবে ধরে নেয়, মানবিক অনুভূতিগুলোর মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। আমার কী প্রয়োজন– সেটা নির্ধারণ করে দেয় প্রতিদিনের বিজ্ঞাপনগুলো। আমরা সেটা পাওয়ার জন্য ছুটতে থাকি এবং না পেয়ে হতাশ হতে থাকি। আমি ভালো আছি কিনা তাও যেন আমার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ওপরই নির্ভরশীল। রাষ্ট্রীয়ভাবে জিডিপির পাশাপাশি মানসিক দক্ষতা উন্নয়নেও উদ্যোগ গ্রহণ এখনই প্রয়োজন।
লেখক: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি
Discussion about this post