মো. শফিকুল ইসলাম
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং ২০২৩ প্রকাশ করেছে। বিশ্বসেরা ১৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি এ তালিকায় টপ ৫০০-এর মধ্যে। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এমনকি পাকিস্তানেরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০০-তে, কিন্তু এখন র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য হতাশাজনক। কারণ শিক্ষায় ভালোভাবে বা গুণগতভাবে উন্নতি না ঘটলে কোনো উন্নয়নই টেকসই করা সম্ভব নয়।
তবে এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এই র্যাঙ্কিংয়ে ছয়টি সূচকে মোট ১০০ নম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল্যায়ন করে কিউএস। এর মধ্যে একাডেমিক খ্যাতি ৪০, চাকরির বাজারে সুনাম ১০, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ২০, শিক্ষকদের গবেষণা ২০ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতে ৫ নম্বর ধরা হয়। এই সূচকগুলোতে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা মানা হয় না বা নেই। মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষকের পদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ছাড় করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৩৪০। শিক্ষক রয়েছেন ২১০ জন।
গড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত দাঁড়ায় ৩৯ :৭১। অর্থাৎ ৪০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। তথ্য নিলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা পাওয়া যাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পলিসি নিতে হবে, যাতে বৈদেশিক শিক্ষার্থী ভর্তি এবং কিছু বিদেশি ফ্যাকাল্টি মেম্বার নিয়োগ করা যায়। গবেষণার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া উচিত এবং প্রমোশনের জন্য গবেষণার মান সংযুক্ত করে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দ মানে খরচ নয় বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। তাহলে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন সম্ভব। একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম বাড়াতে হলে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এখন দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকেন কর্তাব্যক্তিরা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব বন্ধ করা সময়ের দাবি। শিক্ষক নিয়োগে কোনো ধরনের আপস করা ঠিক হবে না। শিক্ষক নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। উপাচার্যদের আরও সতর্ক থাকতে হবে শিক্ষক নিয়োগে এবং স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট সেরা ৫০০ তালিকায় কীভাবে অবস্থান করা যায়, সে বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তার সময় আসছে। তা করতে হলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। মৌলিক সূচকগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতি ঘটাতে হলে প্রথমে সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। নিয়ম করতে হবে- গবেষণা ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহারে মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া হয়। এটা ঠিক নয়। যারা মাস্টার্স করবে, তাদের গবেষণানির্ভর ডিগ্রি দিলে গবেষণার সংখ্যা এবং শিক্ষার মান বাড়বে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক খ্যাতি বাড়াতে সহায়তা করবে।
শিক্ষকদের পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় গুরুত্ব না দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বৃদ্ধি করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রুত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষকের গবেষণার মান বৃদ্ধি করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পদোন্নতি পেতে পিএইচডি ডিগ্রিসহ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা থাকতে হবে- এ ধরনের নিয়ম করা জরুরি। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ করে গঠনমূলক রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, নোংরা রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংঙ্কিংয়ে স্থান না পাওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে হচ্ছে।
মো. শফিকুল ইসলাম :সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
Discussion about this post