মাসুদ উর রহমান
কথায় আছে ‘সখী, যার যার মান রাখি’! আমরা সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ। ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই স্বীয় মর্যাদার কথা। হাত কচলাকচলির স্বভাবে দুষ্ট আমরা ঊর্ধ্বতন তো বটেই, অধস্তনকে তোষামোদ করতেও আমাদের লজ্জা হয় না।
সময়ের ব্যবধানে শিরোনামটি কেমন উল্টে গেল। উন্নতকে সরিয়ে অবনত জায়গা করে নিল। স্বয়ং দিল্লির অধিপতি বাদশাহ আলমগীরের শিক্ষকের প্রতি মহানুভবতায়, সৌজন্যতায় বিগলিত হয়ে যে মৌলভি-শিক্ষক একদা উচ্ছ্বাস ভরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির’—তা আজ কেবলই যেন বইয়ের পাতায় শেখা একটি বুলি!নানাবিধ ঘটনায়, দুর্ঘটনায় দুর্বল ব্যবস্থাপনায় বিচলিত, বিপর্যস্ত শিক্ষক যেন আজ হৃতসর্বস্ব! অথচ এই আমার ছোটবেলায়ও সমাজের কাছে শিক্ষকেরা ছিলেন আদর্শিক মানদণ্ড। গ্রামের প্রতিটি সামাজিক আয়োজনে মধ্যমণি হয়ে থাকতেন একজন শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে কিংবা শ্রেণিকক্ষের বাইরে, সর্বদা শির উঁচু করে চলা শিক্ষক আজ হরহামেশা হচ্ছেন লাঞ্ছিত-অপদস্থ-অপমানিত!
একদা শিক্ষকদের চোখে চোখ রেখে কথা বলাটাই যেখানে বেয়াদবি বলে বিবেচিত হতো, সেখানে আজ নিজ ছাত্রের হাতে প্রহৃত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়াটা অমোঘ নিয়তি নয়তো? এমন তো না যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এখানেই শেষ! বরং বলা যায় আরও ভয়ংকর চিত্র অবলোকনের হয়তো শুরু।
আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার আসলে মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন। কিন্তু নড়াইলের কলেজ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এমন যন্ত্রণাক্লিষ্ট অপমান কেমন করে ভুলে থাকবেন? বরং মরার আগে মরবেন ক্ষণে ক্ষণে!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দিকীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ তো এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই। এত আলোচনা, বিশ্লেষণ তো তাহলে কোনো কাজে আসছে না। উৎপল কুমারকে প্রহার করা শিক্ষার্থী জিতু নাহয় বখে যাওয়া, লাইনচ্যুত মাদকাসক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আশিক উল্লাহও যখন একই দোষে দুষ্ট, তখন বুঝতে হবে সমস্যার উৎসমূল অনেক গভীরে। পচন ধরেছে আমাদের মনোজগতে।
শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার অল্পবিস্তর ঘটনা হয়তো নতুন নয়। তবে ২০১৬ সালের ১৩ মে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি সবাইকে খুব বিব্রত-বিচলিত করেছিল নিদারুণভাবে। স্বয়ং জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে তাঁকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানোর দৃশ্য মিডিয়ার কল্যাণে স্বচক্ষে দেখে দেশবাসী যারপরনাই স্তম্ভিত হয়েছিল। প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। চলতি বছরেও একই অভিযোগে লাঞ্ছিত করা হয় মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে। সেই ঘটনার মধ্যেই অনুরূপ অভিযোগে লাঞ্ছিত
হতে দেখলাম লতা সমাদ্দার নামের আরেকজন শিক্ষককে।
এই যে একের পর এক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখব, বখাটে ছাত্র জিতুর ঘটনাটিই কেবল ঘটেছে ব্যক্তিগত আক্রোশে এবং নিজেকে ‘নায়ক’ হিসেবে বান্ধবীর সামনে উপস্থাপন করার বিকৃত মানসিকতার প্রয়োগ হিসেবে। বাকি সবগুলো ঘটনাতেই ছিল অর্থ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, তথা ব্যক্তিস্বার্থসংশ্লিষ্ট।
আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা কিন্তু থেমে নেই। ঘটছে প্রতিনিয়ত নীরবে-নিভৃতে। ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন ব্যবসার উর্বর ক্ষেত্র। এটিই একমাত্র ব্যবসা যেখানে লোকসানের কোনো সুযোগ নেই। আর এই ব্যবসার মহাব্যবস্থাপক হলেন ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিষ্ঠানপ্রধান। তাঁরা কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ও আজ্ঞাবহ চাটুকার শ্রেণির শিক্ষক দিয়ে একটি বলয় সৃষ্টি করে
সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে রাখেন। তাঁদের থাকে একটি পোষ্য ছাত্র বাহিনীও। যাদের কাজ ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে শিক্ষকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা এবং সেসব ভিডিও ধারণ করে কর্তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া। যেমনটি ঘটতে দেখেছি আমরা মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রে।
বিরুদ্ধ মত এই ব্যবস্থাপনা কমিটির মোটেও সহ্য হয় না। তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করলে তাঁর টুঁটি চেপে ধরা হয়। আর এ ক্ষেত্রে টুঁ শব্দ করা লোকটি যদি হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তাহলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে অতি সহজে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মন্ত্রে উত্তেজিত ছাত্র-জনতাকে দিয়ে শায়েস্তা করা যায় দারুণভাবে।
শিক্ষককে নিগৃহীত করার সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। আর্থিকভাবে বঞ্চিত করার অভিপ্রায়েই হোক বা সামাজিক মর্যাদায় ছোট করার অভিপ্রায়ে—রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষককে দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে চতুর্থ শ্রেণির মর্যাদায় আসীন করে রেখেছে অত্যন্ত সুচতুরভাবে। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। অথচ তাঁদের বেতনক্রম সরকারি অফিসের ড্রাইভারের সমতুল্য! ভাবা যায়? বিসিএসধারী শিক্ষক যাঁদের আমরা প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিই, তাঁরাও যে ভালো নেই তার উদাহরণ নিকট অতীতে একজন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) কর্মকর্তাকে অপর বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তার পা ধরতে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হওয়া।
কোন প্রেক্ষাপটে আমরা পা ধরি বা ধরতে বাধ্য হই, সেটি বিবেচনায় নিলে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কোন পর্যায়ে নেমেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলঙ্কাতেও শিক্ষক মানে শিক্ষক। তিনি যে পর্যায়েই পাঠদান করুন না কেন তাঁর বেতনক্রম, সামাজিক অবস্থান সবার ওপরে। তাহলে আমাদের দেশে কেন শিক্ষকদের মধ্যে এমন শ্রেণিবৈষম্য? কেন মনে করতে হয় উনি ব্রাহ্মণ, তিনি ক্ষত্রিয়, অন্যজন বৈশ্য বা শূদ্র?
কারণ শিক্ষা যে হতে পারে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ, এ ব্যাপারটি রাষ্ট্র হয় বোঝে না কিংবা বোঝার চেষ্টা করে না কিংবা হতে পারে ব্রিটিশ মানসিকতায় কেরানি শ্রেণি তৈরির অপকৌশল!
দায় আমাদের শিক্ষকদেরও। কথায় আছে ‘সখী, যার যার মান রাখি’! আমরা সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ। ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই স্বীয় মর্যাদার কথা।
হাত কচলাকচলির স্বভাবে দুষ্ট আমরা ঊর্ধ্বতন তো বটেই, অধস্তনকে তোষামোদ করতেও আমাদের লজ্জা হয় না। কিসে আমার অহংকার, কিসে আমার গরিমা কিংবা ক্ষমতার পরিধিই-বা কী, সে সবে আমরা অজ্ঞ!
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি ঘটনা বলি। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ঢাকা বিজ্ঞান কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হতে হয় স্যারকে। বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হওয়ার ন্যূনতম নম্বর থেকে দুই কম, অর্থাৎ ৫৯৮ পাওয়া এক ছাত্রকে তার শিল্পপতি বাবা নিয়ে এলেন ভর্তি করাতে। স্যার বললেন, ‘সম্ভব নয়, তাহলে যে আমাকে আরও ৫০ জনকে নিতে হবে।’ শিল্পপতি বললেন, ‘তাহলে স্পেশাল কেস হিসেবে নিন।’
স্যার বললেন, ‘ওকে নাহয় নিলাম। কিন্তু সমান নম্বর পাওয়া অন্যদের বাদ দেব কোন যুক্তিতে?’
শিল্পপতি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তাহলে নেবেন না?’
স্যার বললেন, ‘আপনিই বলুন কী করে নিই?’
অনেক কথার পর শিল্পপতি বললেন, ‘বেশ, দেখা যাবে কী করে ভর্তি না করেন?’
পরের দিন শিক্ষা বিভাগের প্রধান ডিপিআই শামসুল হক ফোন দিলেন ছেলেটিকে নিয়ে নেওয়ার জন্য। স্যার ডিপিআইকে বোঝাতে সক্ষম হলেন। তার তিন দিন পর ফোন এল তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকারের কাছ থেকে। স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী বললেন, ‘২ নম্বরেরই তো ব্যাপার। নিলে কি খুব অসুবিধা হবে?’
স্যার বললেন, ‘আপনি বললে আমি নিয়ে নেব। কিন্তু অন্তত পাঁচ শ লোকের কাছে আমাকে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। আপনি সবার শ্রদ্ধেয়। আপনার অসম্মান হবে।’ স্পিকার কিছুক্ষণ ভেবে ‘ঠিক আছে, থাক তাহলে’ বলে ফোন রেখে দিলেন।
দুই দিন পর ফোন এল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে। এবার আর অনুরোধ নয়। সরাসরি আদেশ: ‘নিয়ে নিন ছেলেটাকে।’
স্যার বোঝালেন, ‘ছেলেটাকে ভর্তি করতে হলে ভর্তির নীতিমালা অস্বীকার করতে হয়।’
‘আইন মেনে সবকিছু করা যায় না?’
‘আপনি বললে আমি অবশ্য নেব। আপনি ওর দরখাস্তের ওপর আমাকে লিখিত নির্দেশ দিন।’
মন্ত্রী মফিজউদ্দিন সাহেব ব্রিটিশ আমলের মানুষ, লিখিত আদেশের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন।
সবকিছু ব্যর্থ হতে দেখে ভয়ংকর চেহারা নিয়ে সেই শিল্পপতি ছেলেসহ স্যারের অফিসে গেলেন তারও দুই দিন পর। বসার অনুরোধ উপেক্ষা করে ধমকের স্বরে স্যারকে বললেন, ‘জানেন আপনার মতো এক শটা মাস্টারকে আমি কিনতে পারি…।’ স্যার বললেন, ‘আপনি কি জানেন, আপনার মতো
এক শটা অশিক্ষিতকে আমি লেখাপড়া শেখাতে পারি?’
পরের অংশটুকু আরও চমকপ্রদ। কিন্তু লেখা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে বলে শেষ করতে হচ্ছে। একজন কনিষ্ঠ অধ্যাপক হয়েও তাঁর পদমর্যাদাকে যেমন দৃঢ়তায় রক্ষা করেছেন, তা আজকের বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো সম্ভব? কিসে সমস্যা? কোথায় ঘাটতি? সেই ঘাটতি পূরণে আমাদের সদিচ্ছা আছে? সত্যি বলতে কি, সেই দৃঢ়তা ফিরে পাওয়ার উপযুক্ততা যত দিন না তৈরি হচ্ছে, তত দিন শির উন্নত হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
Discussion about this post