মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ের চীনের সাথে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই সম্পর্কের কোনও পরিবর্তন করেনি। আজ পর্যন্ত ওই সম্পর্ক চলমান রেখেছে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরো সময় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আওয়ামী লীগ নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গত এক দশকে ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সদা তৎপর থেকেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে। পদ্ম সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পসহ বাংলাদেশের নানা প্রকল্পে চীনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। চীনের সিস্টার সিটি প্রকল্প ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হয়েছে। চীনও একইভাবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে সাবমেরিন প্রদান, বাংলাদেশের জন্য শতভাগ শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা প্রদান, মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতু নির্মাণসহ অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে নানা সহযোগিতা করে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে।
যদিও করোনাকালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে চীনের করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল আটকে যাওয়া এবং পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চীনের বদলে কোরিয়ান কোম্পানিকে প্রদান করা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চীনা দূতাবাসের জন্মদিনের উপহার সামগ্রী প্রদান প্রভৃতি ঘটনা তার অন্যতম প্রমাণ। কিন্তু বাংলাদেশ ও চীন উভয় রাষ্ট্রই আন্তরিকভাবে সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর করতে তৎপর হয় এবং খালেদা জিয়াকে জন্মদিনের উপহার দেওয়ায় চীনা দূতাবাসের দুঃখপ্রকাশ এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে ভারতের করোনা টিকা সরবরাহের সমস্যার সুযোগে চীনের বাংলাদেশের করোনা টিকা সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ চীন সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। ‘আওয়ামী লীগ ভারতবান্ধব রাজনৈতিক দল, এমন প্রচার থাকলেও বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কোনও মিত্র চীনের নেই।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ওই সরকার কর্তৃক চীনের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার ঘটনা ঘটে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে তাইওয়ানের দূতাবাস খোলা হয়। অবশ্যই এক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের উৎসাহ ছিল বেশি। কিন্তু জোটের নেতৃত্ব যেহেতু বিএনপির হাতে ছিল তাই চীন তার দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির প্রতি মনোক্ষুণ্ন হয় এবং বিএনপির বিরোধী আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে,। যার সুফল বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গত এক দশকে পেয়েছে। তাই জামায়াতের সঙ্গে জোট বলবৎ থাকলে চীন মনে হয় না বিএনপির সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে শেষ পর্যন্ত আগ্রহী হবে। অন্যদিকে বিএনপিরও আপাতত জামায়াতকে পরিত্যাগের কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও চীনের সম্পর্কের ফাটল ধরার কোনও সম্ভবনা নেই।
দক্ষিণ এশিয়ায় একাধিপতি হতে ‘চীনা ড্রাগন’ দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব সরকার হয় চীনাপন্থী, না হয় চীনের কাছে এমনভাবে ঋণী যে চীনের বিরোধিতায় টুঁ-শব্দ করার সাহস তাদের নেই। ভারতকে চাপে রাখার ‘চীনা নীতি’র বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সমর্থন তাই চীনের জন্য জরুরি। বাংলাদেশে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ থাকায় অবশ্য চীনের উপর্যুক্ত ভাবনার বিকল্প ভাবার সুযোগও নেই।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও আমেরিকার প্রভাব যেমন চরম বাস্তবতা, তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীনা প্রভাবও চরম সত্য। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত-আমেরিকার ওই বলয়ের বিপরীতে চীনা বলয় কতটা প্রভাব রাখতে পারবে তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তবে চীনের বিদেশ নীতির বৈশিষ্ট্য বলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারেই চীনের আগ্রহ বেশি। ওই কারণে তারা বাংলাদেশে কোন সরকার ক্ষমতায় এলো বা কে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লো তা নিয়ে চীনের কোনও মাথাব্যথা নেই। সবসময় তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করতে চায়। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব থাকলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত আমেরিকা বলয়ের যে প্রভাব আছে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও শক্তি আপাতত নেই।
পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের সহযোগিতার কারণে এই সেতু উদ্বোধনের পর পর বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়বে বলে জনমনে ধারণা থাকলেও বাস্তবে এমন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার উত্থান-পতনে চীনের কৌশলী ভূমিকা এমন ইঙ্গিত দেয় যে চীনা নীতি হচ্ছে, কাবুলিওয়ালাদের মতো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা। জগৎ শেঠের মতো রাজনৈতিক মাফিয়া হওয়ার কোনও ইচ্ছে তাদের আপাতত নেই।
অবশ্য কোনও দল বা সরকারের নয়, বাংলাদেশের স্বার্থ প্রাধান্য পেলে বাংলাদেশের দূরদর্শী সরকার ও সব রাজনীতিবিদের উচিত হবে কোনও একটি বিশেষ রাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে ভারত-আমেরিকা ও চীনা প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ, স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের সারথী হতে পারে। তবে বাংলাদেশ চাইলেই সবসময় তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারবে এমন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবসময় ‘বিগ ব্রাদারদের’ অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেই বিষয়টি মনে রাখা দরকার। বড় রাষ্ট্রগুলো সবসময় তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে বড় করে দেখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ‘বিগ-ব্রাদার্সে’র নীতি একই হবে। তাই বিশেষ কোনও দেশের বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের চেয়ে তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে যে রাজনৈতিক দল সহায়তা করবে বলে মনে করে, তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তৎপর হবে।
ওই বড় রাষ্ট্রগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ যা মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তার জটিল হিসাব-নিকাশের মধ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে রয়েছে। আপাতত এর বাইরে বের হবারও কোনও সুযোগ বাংলাদেশের জন্য নেই। আর উপর্যুক্ত ভূ-রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক স্বার্থই বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করবে। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রকেন্দ্রিক বিশ্ব-বাণিজ্যের আধিপত্যের ওপর ও সমুদ্রসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি সেভেন সিস্টারসহ ভারতের সীমান্ত এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা ও ভারত রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ভারতের নিকট বাংলাদেশ হৃৎপিণ্ডের সমান দামি। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ওপর ভারত-মার্কিন বলয় সবসময় প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে। অন্যদিকে চীনের স্বার্থ কেবল অর্থনৈতিক। তাই পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের যত সহযোগিতা থাকুক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও দলের পক্ষ নেবে না বলে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে যতবারই দাবি করুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে চীনের চেয়ে ভারত-আমেরিকা বলয়ের প্রভাব প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বেশি থাকবে।
সাম্প্রতিক পাকিস্তান শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চীনকে সর্বদা ‘কাবুলিওয়ালা’র ভূমিকায় দেখা যাবে। চীনের জগৎ শেঠ হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post