কাকলী প্রধান
বড় বড় বস্তা ভর্তি বই পিঠে স্কুলে যায় আমাদের সন্তানেরা। শিক্ষার ভারে ওরা মেরুদণ্ড সোজা করে আর দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়াতে শেখেও না। তবু বোকা অভিভাবক আমরা, খুশি হই গর্বিত হই। কয়েক বছর বাদেই হতাশার সাগরে ডুবতে থাকি। কপাল চাপড়াই। হায় একি শিক্ষায় শিক্ষিত আমার সন্তান! উদ্ধত, মারমুখো, বেয়াড়াপনায় পারদর্শী এই কি আমাদের সন্তান! হবে নাইবা কেন?
যখন বস্তা ভর্তি বই নিয়ে চলেছে যে বিদ্যালয়ে আমরাতো কেউ প্রশ্ন তুলিনি কী আসলে আছে বস্তার ভেতরে, শিক্ষা নাকি অন্য কিছু! শুধু পাঠ্য বই-ই কি যথেষ্ট একটি মানুষ গড়ার জন্য নাকি আরও কিছু উপাদান প্রয়োজন! আর স্কুল পাঠ্য বই বিষয়ই বা কি ধরনের উপাদান সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তার হিসাবনিকাশও কি আমরা অভিভাবকেরা সচেতনভাবে করেছি কখনো!
আদতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই হয়ে গেছে একেবারে অন্তঃসার শূন্য। তা না হলে ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার মতো ঘটনা সমাজ মানানসই কোনো ঘটনা?
আমাদের বরং রাষ্ট্রের কাছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে প্রশ্ন তোলা উচিত এবং বিচার দাবি করা উচিত আমার সন্তান হত্যাকারী কেন? কী এমন আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যা আমার সন্তানকে আদৌ একজন ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারছে না?
কী এমন ভাষাগত দুর্বলতা আছে আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় যা আমার সন্তানের রক্তে ড্রাগের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে! আস্থা করছে তাদের ব্যক্তি সত্ত্বায়! কী এমন উপকরণ আমাদের মস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যার কারণে আমি এবং আমার সন্তান খুব সহজেই যে কারুর হন্তারক হয়ে উঠেছি!
আমাদের বরং রাষ্ট্রের কাছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে প্রশ্ন তোলা উচিত এবং বিচার দাবি করা উচিত আমার সন্তান হত্যাকারী কেন? কী এমন আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যা আমার সন্তানকে আদৌ একজন ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারছে না?
কয়েক বছরের বাংলাদেশ প্রেক্ষিত ভিন্ন বার্তা দেয় বটে। শিক্ষক হত্যা, শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো বিষয়গুলো খুবই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে আজকাল। অনেকটা গা সওয়ার মতো হয়ে গেছে।
অনেকেই একে নতুন একটা ঘটনা বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু এটা কি সত্যিই নতুন ঘটনা! নাকি আগে থেকেই ঘটতে শুরু করেছে কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো সেদিকটায় নজর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। খুব পরিকল্পিত উপায়ে নষ্ট করা হয়েছে গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত সংগঠনগুলোকে।
শক্তিশালী রাষ্ট্রের অবকাঠামোয় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব এবং কাজগুলো করে না বা করতে পারে না। খুব লজ্জাজনকভাবে মাথা নত করেই বলতে হয় আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দলীয় শ্লোগানে মুখরিত আজ।
তারা বড় বড় মানুষ তারা প্রতিনিয়ত ভাবছেন প্রতিনিয়ত লিখছেন। আমরা যারা ছোট ছোট মানুষ তারাও মাঝে মাঝেই বিচলিত হয়ে কড়া নাড়ছি সাধ্যমতো। আমাদের কথা কানে তুলবার মতো ‘একজন’ মানুষ সম্ভবত নেই।
কিশোরেরা ইভটিজিং করছে, কিশোরেরা গণধর্ষণ করছে আমরা বারবার পথে নামছি ঐসব কিশোর অপরাধীদের শাস্তি এবং বিচারের দাবিতে। ওরা কারা? ওরা আমাদেরই সন্তান। ওদের বিচার করবেই বা কে বা কারা? ওদের হত্যাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল যে প্রতিষ্ঠান তারা!
আমি এই পদ্ধতিগত ত্রুটির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বলতে চাই এটা কোনো সমাধান নয়। এটা অতি ভুল ধারণাবশত উদ্ভাবিত ব্যবস্থা এবং অত্যন্ত মোটাবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ভুল ব্যবস্থাপনা।
খুব পরিকল্পিত উপায়ে নষ্ট করা হয়েছে গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত সংগঠনগুলোকে। শক্তিশালী রাষ্ট্রের অবকাঠামোয় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব এবং কাজগুলো করে না বা করতে পারে না।
সাভারে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা, নড়াইলের শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনাগুলো আমাদেরকে আবার উদ্বেগ আশঙ্কায় হতবিহ্বল করে তুলেছে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে এবং অন্যদিকে সাভারের যে ছাত্র শিক্ষককে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করল সেটিও ঘটেছে দিনের আলোয় জনসম্মুখে।
আমি এখানে ছোট্ট একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। একদিন রাতে ৮-৯টার দিকে আমি হাতিরঝিল পার হচ্ছিলাম। গাড়ির আলোয় দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে দশ-বারোজন কিশোর তরুণ আরেকটি কিশোরকে বেধড়ক মারছে। ছেলেটি প্রায় অচেতন। ঐ জটলা পাস কাটিয়ে দিব্যি প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটি গাড়ি চলে গেল।
আমি আমার চালককে বললাম গাড়িটি ঠিক ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে প্রচণ্ডভাবে হর্ন বাজাতে এবং অন্যান্য গাড়িগুলো যেন পাস কাটিয়ে চলে যেতে না পারে। আমার চালক তাই করল। আমরা গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে তাদের প্রথমত ছত্রভঙ্গ করে দিলাম এবং আহত কিশোরকে রক্ষা করার চেষ্টা করলাম।
জানা গেল সেও কিছুদিন আগে বিপক্ষ কিশোর দলের একজনকে এমনভাবে পিটিয়েছে এবং আহত কিশোর ঐ বিপক্ষ কিশোর দলের কারও বোনকে উত্ত্যক্ত করেছে। যাই হোক প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম এজন্য যে, আমাদের দেখে আরও দশ বারোটি গাড়ি গাড়ির চালক এবং সাধারণ মানুষ নেমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বিষয় হলো কাউকে এগিয়ে আসতে হবে।
আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের রাজনৈতিক চর্চা ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি হতে উদ্বুদ্ধ করে না। নৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন করে না। মানুষের করা উচিত, কী করা উচিত নয়। সৌন্দর্য এবং শরীরের ধারণা অত্যন্ত দুর্বল। দর্শন এখানে শুধুমাত্র উপরি ক্লাসের পাঠ্যবিষয়। ফলাফল, জাতিগতভাবেই আমরা স্থূল জ্ঞান সম্পন্ন হয়ে উঠছি।
শেষে এইটুকু বলতে চাই, চারপাশের ভাইবোন, বন্ধুরা তাদের সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমাদের মতো কিছু হাবাগোবা বোকা মানুষ গোঁ ধরে বসে আছি। কী? না, আমাদের সন্তানেরা দেশেই থাকবে, দেশেই পড়বে, দেশের জন্য ভাববে দেশের জন্য করবে। অন্তত যতদিন তাদের ইচ্ছে হবে।
আমাদের জন্য বিষয়গুলো খুব লজ্জার। আমাদের শুনতে হয় ভুল করো না এই দেশের কিচ্ছু হবে না। দেশে রেখে সন্তানের প্রতি অবিচার করো না! ভাবি সত্যি কী বিচিত্র এই দেশ, কী বিচিত্র মূর্খ প্রজাতির মানুষ এই আমরা!
লেখক- কাকলী প্রধান ।আলোকচিত্রী
Discussion about this post