মো. মাহমুদুল হাছান
বর্তমানে বহুল ব্যবহূত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে টিকটক একটি আলোচিত নাম, যেটি সম্পর্কে শোনেনি এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে বিনোদনের এটি অন্যতম মাধ্যম। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও লাইকি থেকেও এর গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বব্যাপী বেড়েই চলেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কেউ সহজেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টিকটক ভিডিও বানিয়ে শেয়ার করতে পারে। এটা হতে পারে অভিনয়, গান, কৌতুক, ফিটনেস, ভ্রমণ, কারিগরি দক্ষতা, স্বাস্থ্য, কবিতা, মোটিভেশন ইত্যাদি। টিকটক অ্যাপের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে শুধু ভিডিও শেয়ার করাই নয়; কেউ চাইলে এখান থেকে এমন হাজারো মানুষের ভিডিও দেখতেও পারে। একটি ভিডিও শেয়ার করার সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছে যায় লাখ লাখ টিকটক ব্যবহারকারীর কাছে। এখানে থাকা বিভিন্ন ধরনের ভিডিও ইফেক্ট, ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস বা গান যে কোনো ভিডিওকে অসাধারণ করে তোলে। এ অ্যাপের মাধ্যমে ভিডিও বানাতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। টিকটকে একটি শর্ট ভিডিও বানাতে গড়ে তিন-চার মিনিট সময় লাগে।
আমাদের সমাজে তথাকথিত যে কিশোর গ্যাংয়ের কথা শোনা যায়, তাও মূলত এভাবেই তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা কিংবা দক্ষতা অর্জন না করে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং তা প্রস্তুত করতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অনেকে আবার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এমন কাজে অধিক সময় দেওয়ার কারণে মস্তিস্কের বিকৃতিজনিত সমস্যায় পড়ে এবং এক পর্যায়ে তারা হতাশায় ভোগে। ফলে এদের বড় একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন মাদকাসক্তি, ধূমপান, জুয়া, নারীতে আসক্তিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
যেসব শিক্ষার্থী টিকটকের সঙ্গে জড়িত, তাদের আচার-আচরণেও এমন কিছু প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়; যা সমাজ ও পরিবারের কাছে অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত। তাদের মধ্যে খিটখিটে স্বভাব, অমনোযোগিতা, অশিষ্টাচার, অসম্মানবোধ ও কথায় কথায় রেগে যাওয়া, বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ইত্যাদি আচরণিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যা টিকটকের ক্ষতিকর প্রভাবেই হয়।
এ ছাড়া টিকটকের প্রতি তরুণ প্রজন্ম এমন আসক্ত হয়েছে যে, নিজেকে বেশি ফোকাস করতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনকি হাসি-ঠাট্টার ছলে তাদের বন্ধুবান্ধব নিয়েও টিকটক বানানো শুরু করে। ফলে নানা ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল বা স্নায়বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে তারা ঝগড়া-বিবাদ ও খুনখারাবিতে জড়িয়ে পড়ে, যা নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফল। আজকাল টিকটক এমনই একটি আসক্তিতে পরিণত হয়েছে যে, রাস্তাঘাট বা কোনো নিরিবিলি স্পটে গেলে টিকটক নির্মাতা সেজে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা তাদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে অযথা সময় নষ্ট করে এবং গুটি কয়েক সহপাঠী-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাহুল্য আড্ডায় মেতে ওঠে।
টিকটকের কারণে সৃষ্ট এসব অপরাধ রোধে বর্তমানে অনেক দেশেই এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ টিকটকে থাকা বিভিন্ন ভিডিও ও তথ্য শুধু ব্যক্তিগত গোপনীয়তাই লঙ্ঘন করছে না; বরং তরুণ শিক্ষার্থীদের মাথা-মগজ এমনভাবে ধোলাই করছে; তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে এবং নৈতিকতার মানদণ্ডে ভীষণভাবে পদস্খলিত হচ্ছে। এ ছাড়া এদের দেখে মনে হয়, এসব ছেলেমেয়ে সম্পূর্ণ কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় বশীভূত এবং তাদের ওপর বাবা-মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে তারা বখাটেপনা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠছে। তাই টিকটক ব্যবহারে আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদুল হাছান: অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
Discussion about this post