আসিফুর রহমান সাগর
মানুষ সব সময় মানুষের সঙ্গে চলতে চায়, মিলেমিশে থাকতে চায়। মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। আবার, একই সঙ্গে সব মানুষই মাঝেমধ্যে একলা থাকতে ভালোবাসে। তবে, নিরবচ্ছিন্ন একাকিত্ব মানুষকে বিমর্ষ, বিষণ্ণ করে তোলে। অনেক সময় হতাশাগ্রস্ততা থেকেও মানুষ একাকিত্বকে বেছে নেয়। এর উলটো দিকও রয়েছে। আমরা এমনটা দেখেছি, বিশ্বের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী ধ্যান করতে একাকী স্থান বেছে নিয়েছেন। কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের জীবনী আমাদের জানায়—তারা একাকিত্বকে উপভোগ করেন। একাকী মুহূর্তগুলো তাদের ভাবনাকে রূপ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোই শুধু নয়, সারা বিশ্বের সামাজিক কাঠামোর প্রধান অংশ হচ্ছে পরিবার। আধুনিককালে, মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো বদলে গেছে। যৌথ পরিবার কাঠামো ভেঙে এখন একক পরিবারের মধ্যেই শান্তি খুঁজছে মানুষ। এর পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তারের যুগে মানুষের যোগাযোগের মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও মানুষের একাকিত্ব কিন্তু ঘুচছে না। মানুষকে দিন দিন আরো বেশি নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে নিচ্ছে।
মনোবিদরা বলছেন, আগের যে কোনো কালের চেয়ে এখন মানুষ নিঃসঙ্গ বোধ করে সবচেয়ে বেশি। প্রিয়জনের একটু স্পর্শ, হাতের একটু ছোঁয়া, মা-বাবার আদর মনে যে তরঙ্গে দোলা দেবে তা কেউ দিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা সার্জন জেনারেল ডক্টর বিবেক মূর্তি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, একাকিত্ব ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যগত মহামারি। তিনি বলেন, ৪০ শতাংশের বেশি মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক একাকীত্বে ভুগছেন। সুখ-দুঃখের আলাপ করার মতো নিকটজনের সংখ্যা মানুষের দিন দিন কমছে। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কিশোর-কিশোরীরা সহিংসতা, ড্রাগ ও গ্যাংকালচারে ঝুঁকে পড়ছে।
কথাসাহিত্যিক ও মনোবিদ মোহিত কামাল বলেন, মানসিকভাবে কেউ যখন কোনো এক জনকে যার সঙ্গে তার সামাজিক সম্পর্ক বা বন্ধন রয়েছে, যাকে সে আশা করছে, যোগাযোগ করতে চাইছে, মিশতে চাইছে কিন্তু তার চাওয়ার গভীরতা অনুযায়ী সে তাকে পাচ্ছে না—তখন তার মনে যে কষ্টকর অনুভূতি হয় সেটিই একাকিত্ব। এই একাকিত্ব কোনো রোগ নয়, কিন্তু এটা এমন এক মানসিক অবস্থা যা থেকে নিজেকে বের করতে পারে না মানুষ। বরং এই একাকিত্ব তাকে গ্রাস করে। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা— আবেগের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। অসুখী, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, শূন্যতা ও একঘেয়েমি অনুভূতি।
মানসিক অবস্থার এ পর্যায় কাটিয়ে উঠতে মোহিত কামাল বলেন, আমরা আমাদের একাকিত্ব দূর করতে পারি যদি সদিচ্ছা থাকে এবং নিজের জীবনটাকে খানিকটা হলেও ভালোবেসে থাকি। যখন আমরা ভালো কাজে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতে সক্ষম হব, একাকিত্ববোধ তখন আমাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না। এজন্য আমরা নিজের কিছু কিছু শখ পূরণ করার চেষ্টা করতে পারি। প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পারি বাগান করার মাধ্যমে। সবসময় মনে রাখতে হবে, জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু নেই।
বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা সংবাদপত্রে নিঃসঙ্গ বেশ কিছু মানুষকেই আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখেছি। সম্প্রতি, এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। করোনাকাল মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। চাকরি, ব্যবসা, সম্পর্ক সবকিছু নিয়েই মানুষকে অসহায়ত্ব গ্রাস করতে দেখা গেছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক সমাজবিদ বর্তমান সময়ে একাকিত্বকে ভয়াবহ মহামারি হিসেবে দেখছেন। যা মানুষকে ভেতরে ভেতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
একাকিত্ববোধ এতটাই প্রকট হয় যে, আপনি বন্ধুদের মধ্যে বা অফিসে অনেকের মধ্যে থেকেও একা বোধ করবেন। মা-বাবা, ভাই বোনদের পাশে কিংবা ভালোবাসার মানুষটির পাশে থেকেও নিঃসঙ্গ বোধ করবেন। আপনার মন অন্য কিছু চাইছে। আবার কখনো কখনো আপনি হতাশ হয়ে যাচ্ছেন এই ভেবে যে, আসলে আপনার মন যা চাইছে তা আপনি পাচ্ছেন না। আর এই না পাওয়া আপনাকে একা করে তুলছে। যা আপনি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছেন না। আবার তা বন্ধু বা স্বজনদের সঙ্গে শেয়ার করলে ঠাট্টার পাত্র হচ্ছেন। এ অবস্হা মানুষকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়।
এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, আমাদের জীবনে চলার পথে আমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হই। সমস্যার সমাধান যখন করতে পারি না, তখন নিজেকে একা মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয় নিজের কাছে নিজেকে। এ সমস্যা যখন প্রকট হয় তখন অনেক আবেগ্রপ্রবণ মানুষ বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। একাকিত্ব যখন গ্রাস করে তখন আমাদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। মনোযোগ কমে যায়। কোনো কাজ ভালোভাবে করা সম্ভব হয় না। আত্মবিশ্বাস কমতে কমতে আমাদের জীবনের আনন্দগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। এরপর একসময় এটি মানসিক সমস্যায় পরিণত হয়। এটি তখনই আশংকার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একাকিত্বকে আমরা যত প্রশ্রয় দেব, এটি তত বেশি গ্রাস করতে থাকবে ভুক্তভোগীকে। একাকিত্ব জীবনকে ঝামেলা না ভেবে মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়া এবং এটিকে উপভোগ করতে হবে। জীবনে বাধা আসবেই, একে মনের জোর দিয়েই কাটাতে হবে। অবসাদের ডুবে গিয়ে কোনো লাভ নেই।
মোহিত কামাল বলেন, যারা একাকিত্ব থেকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হন তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তার আশপাশের মানুষদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। মানুষটি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে নিজের মনকে হালকা করার চাইতে বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাদের নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাওয়া বন্ধুটির খোঁজ নিতে হবে। হয়তো সে স্বজনদের ধমক, বন্ধুদের টিটকারির জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সেটা আমরা করতে দেব না। তাই, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেই যোগাযোগ করে দিতে পারছে না।
Discussion about this post