অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন
বর্তমানে চারপাশের দুনিয়ার খোঁজ খুব কম মানুষই রাখে। ফলে দিনে দিনে কাছের মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে, মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হচ্ছে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জায়গাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত ছিল, সেটাও ভাঙতে বসেছে। তবে ছাত্র-শিক্ষক উভয় পক্ষই সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিলে এ-সম্পর্কের উন্নয়ন আবারও ঘটবে।
শুধু লেখাপড়ার মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর কখনোই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে ছাত্রসমাজের সক্রিয় ভূমিকা থাকাটা খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের বাড়িয়ে দিতে হবে স্নেহ-ভালোবাসার হাত।
বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের, উচ্চশিক্ষার পথ করতে হবে সুগম। তাহলেই একদিন এই সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পাবে মানবিক পৃথিবী। এভাবেই মানবিক ও কল্যাণকর পৃথিবী গড়ে তুলতে করণীয় পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেছেন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন।
কিছু সংকট চোখে পড়ে
আমরা যদি বিদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করি তাহলে কিছু সংকট চোখে পড়ে। উন্নয়নশীল দেশ বা মধ্যম আয়ের দেশ যেটাই বলেন না কেন, আমাদের সব ক্ষেত্রেই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যদিও আমাদের এখানকার শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। তবে তারা কিন্তু বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখে, মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আমি একটা জিনিস মনে করি, আমাদের শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট মেধা আছে। আমরা তাদের যুগের সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারছি না। এটা শিক্ষক হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমরা আশাবাদী হতে পারি, ভবিষ্যতে এই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। আমরা যখন লেখাপড়া করেছি, তখন যেকোনো একটা এক্স-রে মেশিনের জন্য ঢাকায় যেতে হতো, এটা একমাত্র বুয়েটে ছিল। অথচ এখন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই সুযোগ-সুবিধাগুলো শিক্ষার্থীদের দিয়ে থাকে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বাজেট রাখা হচ্ছে। আমরা যে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করছি, এটিই তার প্রমাণ।
সিলেবাস হতে হবে বাস্তবভিত্তিক
আউটকাম বেজ এডুকেশন (ওবিই) ইউজিসির একটি রিকুইজিশন। সিলেবাস হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। প্রতিটি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আউটকাম বেজ এডুকেশনের আদলে সিলেবাস প্রণয়ন করার জন্য ইতিমধ্যে ইউজিসি থেকে নির্দেশনা পাঠিয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা বাইরে থেকে প্রশিক্ষক আনিয়ে শিক্ষকদের ট্রেনিং করিয়েছি। তবে এটা যেহেতু নতুন একটা পদ্ধতি, সুতরাং আমাদের শিক্ষকদেরও এই অভিনব পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে। তবে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি, অতিদ্রুত শিক্ষার্থীরা তথা দেশের মানুষ এর সুফল ভোগ করবে।
গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার বাজেট দিয়ে থাকে। যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আমি গণবিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকে দেখেছি এই প্রতিষ্ঠান গবেষণার জন্য যথেষ্ট বাজেট দেয়। প্রয়োজন হলে আমরা আরও দেব। আর আমরা চেষ্টা করছি কিছু ইকুইপমেন্ট সেট করে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃহৎ পরিসরে গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া যায় কি না। এ ছাড়া আমাদের যে রিসার্চ সেল আছে, সেটা আরও বেশি সক্রিয় রাখার চেষ্টা করব।
শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষামূলক কাজে আগ্রহী করতে শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত হতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে, শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। করোনাকালে অনেকে ঘরবন্দী ছিল, ফলে তারা যেন হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে, মাদক থেকে দূরে থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আমাদের আর্থিক দিক থেকে যে সংকট আছে, সেটা কাটিয়ে উঠে এই সেক্টরের জন্য সর্বোচ্চ বাজেট রাখার চেষ্টা করতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের আরও বেশি তৎপর হতে হবে, শিক্ষার্থীদের প্রতি বিনয়ী হতে হবে, তারা যেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে। পাশাপাশি তদের সব সেক্টরে সম্পৃক্তকরণের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে।
হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই
আসলে মানুষের মনে একটা ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছে—প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তারা লো ক্যাটাগরির। কিন্তু বিষয়টি বাস্তবে এমন নয়। অনেক কারণে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তা ছাড়া আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার তুলনায়, শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্টে অধ্যয়নের জন্য অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হয়। আর এখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো সুযোগ নেই। আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক বছর চাকরি করেছি, এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে করছি। আমি শিক্ষার্থীদের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য দেখি না। তবে যেখানেই শিক্ষার্থীরা পড়ুক না কেন স্কিল বাড়াতে হবে, শিক্ষা এবং সময়কে কাজে লাগাতে হবে।
নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে
আমরা যখন লেখাপড়া করেছি সেই সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র চারটি। আর এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক শটির অধিক। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো আছে। যে হারে প্রতিবছর গ্র্যাজুয়েশন বের হচ্ছে, সেই হারে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে—যেমন গার্মেন্টস সেক্টরে। তবে আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সবাই একটা ভালো চাকরির প্রত্যাশায়। কিন্তু শিক্ষিত এই তরুণেরা যদি ভালো চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের উদ্যোক্তা (খামার, প্রজেক্ট ইত্যাদি) হিসেবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়, তাহলেই এই বেকারত্ব সমস্যা নিরসন হবে, নতুবা সম্ভব নয়।
প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা
প্রজন্মের কাছে একটাই প্রত্যাশা—তারা যেন সব মহামারি অতিক্রম করে লেখাপড়ায় মনোবল ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে আমরা যারা শিক্ষকতা পেশায় আছি, তারা যেন তাদের এই সংগ্রামে সর্বদা পাশে থেকে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারি। আমি মনে করি, বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা যখন তাদের মেধা এবং মনোবল কাজে লাগিয়ে সাফল্যের দ্বার প্রান্তে নিজের পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং সর্বোপরি দেশকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়, তখনই আমাদের প্রত্যাশা পূর্ণতা পায়।
লেখক: উপাচার্য (চলতি দায়িত্ব), গণবিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post