মুসতাক আহমদ
ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের ২১ মে দেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’। এ ঝড়ের ব্যাস ছিল প্রায় দুটি বাংলাদেশের সমান। এতে চট্টগ্রামেই ২৬ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় প্রায় একই আকৃতির আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। এটি ২৬ মে ভারতের ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে। একইভাবে বঙ্গোপসাগরে উৎসারিত ‘অশনি’ নামে অপর ঘূর্ণিঝড় গত ১১ মে অন্ধ্র প্রদেশের উপকূল অতিক্রম করে। অশনি বাংলাদেশের বড় কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও ইয়াসে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিল। রোয়ানু থেকে অশনি পর্যন্ত সাত বছরে সাতটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের নিকটবর্তী ভারতের উপকূলে আঘাত হানে। যদিও এ সময়ে ভারত মহাসাগরে আরও অন্তত অর্ধডজন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানারকম দূষণ থেকে ধ্বংস হচ্ছে বায়ু, মাটি, পানি, বাস্তুতন্ত্রসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ। স্বাভাবিক পরিস্থিতি নষ্ট হওয়ায় বিগড়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। ফলে তাপ, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বের ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৩শ’ কোটিই ক্ষয়িষ্ণু বাস্তুতন্ত্রের কারণে ক্ষতির শিকার। দূষণের কারণে ফি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। ১০ লাখের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তির ঝুঁকি আছে, যার মধ্যে অনেক প্রজাতি খুব বেশি হলে আর মাত্র কয়েক দশক টিকতে পারবে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একটাই পৃথিবী মানে হচ্ছে বসবাসের জন্য এ ছাড়া আর কোনো গ্রহ নেই। এখন আমরা যদি আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে এই গ্রহ স্বাভাবিক রাখতে হবে, যেভাবে রাখলে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করবে না।’ তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশ সৃষ্টির মূল উৎস উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কার্বন, মিথেনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। কেননা তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা এসবের মূলে আছে উষ্ণায়নের প্রভাব। প্রবল তাপ, বন্যা ও খরায় মৃত্যুর ঝুঁকি ১৫ গুণ বেশি। এছাড়া অল্পসময়ে ও অসময়ে অতিবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলে লবণাক্ততার বিস্তার, এর কারণে কৃষি ও মৎস্যসম্পদসহ সার্বিক জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের পেছনে উষ্ণতার দায় আছে। সব মিলে মানবজীবনের এমন কোনো খাত নেই যেখানে পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক প্রভাব নেই। মূলত নানারকম দূষণ থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের কারণে মানুষের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনায় প্রতিবছর ২০ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এই বাস্তবতা সামনে রেখে শনিবার সুইডেনে ‘স্টকহোম+৫০’র আন্তর্জাতিক মিটিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে যে উদ্বাস্তু তৈরি হবে তা এই আন্তঃসম্পর্কিত পৃথিবীতে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায় ভাগাভাগি করে নেওয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, বিশ্বের পরিবেশের বিপন্নদশা অবলোকন করে ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বিভিন্ন দেশের নেতারা বসেছিলেন। এটি ‘এনভায়রনমেন্ট সম্মেলন’ বা ‘স্টকহোম সম্মেলন’ নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সাল থেকে পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে। স্টকহোম সম্মেলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এ বছর স্টকহম+৫০ নামে উল্লিখিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে সুইডেনে। ঢাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্র এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এ সম্মেলনে সবাই একমত হয়েছেন যে, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের সবগুলোই একটি স্বাস্থ্যকর গ্রহের ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ আর জীববৈচিত্র্য হারানোর ত্রিমাত্রিক সংকটের কারণে বিশ্বে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে। এই দুর্যোগ এড়াতে আমাদের সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
Discussion about this post